বিশ্লেষণ

জাতীয় পার্টি কি সরকারের কৌশলের বাইরে ভিন্ন অবস্থান নিতে পারবে

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের সম্প্রতি সরকারবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন
ফাইল ছবি

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টি কখনো স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নিতে পারবে কি না, এই প্রশ্ন আবারও আলোচনায় এসেছে নির্বাচন সামনে রেখে। কারণ, তিন মাস পর আদালতের নির্দেশে দলের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের আবার দলের কর্মকাণ্ডে তৎপর হয়েছেন। তিনি দলীয় কর্মসূচিতে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে থাকছে সরকারের সমালোচনা।

গত কয়েক দিনে দেওয়া বক্তব্যের সমর্থনে তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন— ‘সরকারের সমালোচনা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়।’ সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদেরও অনেকে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু সরকারের কৌশলের বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টির ভিন্ন কোনো অবস্থান নেওয়া বেশ কঠিন, দলটির ভেতরেই এমন ধারণা রয়েছে। সরকারবিরোধী দলগুলোর কাছে এবং সাধারণভাবেও জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, দলটি আগামী নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির দর-কষাকষির লক্ষ্য নিয়ে এখনই একটা অবস্থান তৈরি করতে চাইছে।

গত দুটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সুতার নাটাই ছিল ক্ষমতাসীনদের হাতে। তখনকার ঘটনাপ্রবাহে তা স্পষ্ট ছিল।  ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অংশীদার হয়েছিল জাতীয় পার্টি। দলের তিনজন নেতা আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রী হয়েছিলেন। একই সঙ্গে দলটি বিরোধী দলের আসনে বসেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সমঝোতায় যেতে হয়েছিল জাতীয় পার্টিকে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সংসদেও বিরোধী দলের আসনে রয়েছে জাতীয় পার্টি। নির্বাচন ঘিরে দলটির কর্মকাণ্ডে নানা আলোচনাও রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের বিশেষণও অনেকে ব্যবহার করে থাকেন।

সরকারের হাতে থাকা নাটাইয়ের সুতা ছিঁড়ে জাতীয় পার্টি কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে, সেটি সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো এখনো বিশ্বাস করে না। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের কাছেও জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাতে ছিল মূলত সরকারের সমালোচনা। তিনি সরকারবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন কি না, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়েছে কি না, এসব নানা প্রশ্নে তখন নানা আলোচনা ছিল। সে সময়ই দলটিতে নেতৃত্ব নিয়ে পুরোনো কোন্দল নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছিল।

যদিও তখন  জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক  রওশন এরশাদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। কিন্তু এরপরও জি এম কাদের ও  রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব এবং তার জেরে দলের বিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল। দেবর-ভাবির  দ্বন্দ্বের জেরে দলের চেয়ারম্যানের দলীয় দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

চিকিৎসা শেষে গত নভেম্বরে রওশন এরশাদ দেশে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে জিএম কাদেরের কয়েক দফা বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে সমঝোতা হওয়ার কথা জানিয়েছিল দলটি।  

কিন্তু রওশন এরশাদের পক্ষের একজন সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধার মামলায় গত ৩০ অক্টোবর নিম্ন আদালত  জি এম কাদেরের দলের দায়িত্ব পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তিন মাসেরও বেশি সময় পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে। উচ্চ আদালতের সেই আদেশের পরই জি এম কাদের সরব হয়েছেন। শুরু করেছেন বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া। কিন্তু জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালন নিয়ে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছে এই, যার ভিত্তিতে তিনি দলীয় কর্মকাণ্ড শুরু করেন, হাইকোর্টের সেই আদেশ স্থগিত করার জন্য এবার আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই আবেদন করেছেন জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা। নিম্ন আদালতেও তিনি মামলা করেছিলেন।

সরকারের সমালোচনা করলেও সতর্ক জাপা

নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে জি এম কাদের যেসব বক্তব্য বা বিবৃতি দিচ্ছেন, তাতে নির্বাচনসহ স্পর্শকাতর কিছু ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন— ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গত কয়েক দিনে নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য তিনি যেমন দিয়েছেন, একই সঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের সমালোচনা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে দলটির অন্য নেতারাও বক্তব্য দিচ্ছেন।

কয়েক দিন আগে সংসদে আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য ২০১৪ সালের নির্বাচনে একটি আসনে জেনারেল এরাশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তখন সংসদে জাতীয় পার্টির তিনজন সদস্য সংসদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অংশীদার হলেও সংসদে দলটির সদস্যরা পুরোনো গোমর আবার ফাঁস করে দেন।

সম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টির যে ভূমিকা দেখা যাচ্ছে, তাতে এখন আলোচনায় এসেছে যে দলটি সোচ্চার একটা অবস্থান দেখাতে চাইছে।  

কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন দলের বাইরে স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নিতে পারবে—এমন অবস্থানে দলটি এখনো যেতে পারেনি বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। জাতীয় পার্টির নেতাদেরও অনেকে তা মনে করেন।

যদিও নিষেধাজ্ঞার আগে সরকারের বিরুদ্ধে একটা সরব অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন জি এম কাদের। হাইকোর্টে নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হওয়ার পর তিনি আবার সরকারের অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। কিন্তু যে সময়টাতে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেই তিন মাসের বেশি সময়ে দলের কর্মকাণ্ডে একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কোনো ঝুঁকি নেননি বলে দলটির নেতারা বলছেন।

জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা জানান, আসলে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বাইরে গিয়ে তাদের দলের ভিন্ন কোনো অবস্থান নেওয়া বেশ কঠিন। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড চালাতে হয়।

এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বিএনপির মতো আন্দোলন করার শক্তি এখনো আমাদের নেই এবং আন্দোলন করার জন্য অর্থও নেই। আমরা নির্বাচন সামনে রেখে দলকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এখন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি।’

নির্বাচনই টার্গেট

যেহেতু জাতীয় পার্টির পক্ষে স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নেওয়া অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে কারণে দলটি সরকারের অনুগত্যে থেকেই এখন নির্বাচনের জন্য দলের একটা অবস্থান তৈরির বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্য জানিয়েছেন।

বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসুক বা না আসুক-জাতীয় পার্টি  নির্বাচনে থাকবে। দলটির এই অবস্থান পরিষ্কার বলে মনে হয়েছে। তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টির সমীকরণ এক রকম হতে পারে। তখন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেই দলটিকে নির্বাচনে যেতে হতে পারে। তখন দর–কষাকষির বিষয় থাকে।

বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে তখন জাতীয় পার্টি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারে। এককভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাদের জন্য আসন ছাড় দেওয়ার প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হতে পারে। জাতীয় পার্টির ভেতরে এখন পর্যন্ত এ ধরনের আলোচনা রয়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে শরিক হয়ে আসন ভাগাভাগিতে ২৭টি আসন পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। পরের নির্বাচনগুলোতে ভাগাভাগিতে তাদের আসন কমেছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৪টি আসন ছেড়েছিল।

জাতীয় পার্টির নেতাদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ আগের নির্বাচনগুলোতে আসন ভাগাভাগিতে পর্যায়ক্রমে  তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনছে। এ ছাড়া রংপুর অঞ্চলে জাতীয় পার্টির যে একটা শক্ত অবস্থান ছিল, সেখানে অনেক আসন তাদের হাতছাড়া হয়ে আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে।

সে জন্য দলটি সংসদের ভেতরে ও বাইরে সরকারের বিরোধিতা করে একটি অবস্থা তৈরি করতে চাইছে, যাতে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির দর–কষাকষিতে জাতীয় পার্টি একটি ভালো অবস্থানে থাকতে পারে।

জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেছেন,  তারা এখন নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। ফলে নির্বাচনের সময় আসন ভাগাভাগির বিষয় এলে পরিস্থিতি বিবেচনা করেই তাঁর দল তখন সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টি কোনো অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলে দলটিতে বিভক্তি চরম রূপ নিতে পারে।