এখন বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি গত সংসদে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসিবে পরিচিতি পেয়েছিল। এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের পর সংসদের বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন আ স ম আব্দুর রব। সেই বিরোধী দল তখন ‘গৃহপালিত’ বিশেষণ পেয়েছিল।
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতার আসনে জয়ী ১১ জন সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটি আগের সংসদে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের টানা শাসনে গত দুটি সংসদের সঙ্গে তুলনা করলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও বিরোধী দলের আসনে কোনো পরিবর্তন নেই।
নতুন সংসদে জাতীয় পার্টি কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে পারবে, এটি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলটির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ভোট বর্জন করে সংসদের বাইরে রয়ে গেছে। এমন পটভূমিতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নিয়ে একপক্ষীয় সংসদের চেহারা নিয়েছে বলা যায়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, বড় দুই দলের অনুসারী বা সমর্থক দেশের সিংহভাগ মানুষ। রাজনীতিও বিভক্ত দুই দলকে কেন্দ্র করে। নির্বাচন, আন্দোলনে অন্যান্য দলের বেশির ভাগই দুই দলের নেতৃত্বে ভাগ হয়ে যায়। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবার নির্বাচন বর্জন করে বিএনপির নেতৃত্বে বিভিন্ন দল ও জোট সরকার পতনের আন্দোলনে ছিল। আর আওয়ামী লীগ তার শরিক, মিত্রদের নিয়ে নির্বাচন করেছে।
এখন এই সংসদে দেশের মানুষের বড় অংশের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা যাবে না, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। রাজনৈতিক কোনো আলোচনা হলেও তা হবে একতরফা। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এই প্রশ্নেও সন্দেহ থেকে যায়। তবে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যকে এই সংসদের নতুনত্ব বলা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ সংসদকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন–অর–রশিদ বিরোধী দলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টির ওপর সেভাবে আস্থা রাখতে পারছেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের ওপরই আমার ভরসা বেশি। তাঁরা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনায় সংসদে সোচ্চার থাকবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।’
সংসদে বিরোধী দল দেখছি না। কারণ, জাপাকে বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতার আসনে ভোট করে জিতে এসেছে।মাহবুব উল্লাহ্, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক
এর পেছনে কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হারুন–অর–রশিদ বলেন, সংসদে দলের বাইরে ভোট দেওয়া যাবে না বলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। ফলে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে করেন তিনি।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী। সংসদে তাঁদের নিয়ন্ত্রণও থাকবে সরকারি দলের কাছে। স্বতন্ত্র সদস্যরা নিজেরা স্বাধীনভাবে অবস্থান নেবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ তাঁদের দু–তিনজন ছাড়া অন্য সবাই শুরু থেকেই সংসদে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলে আসছিলেন। সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের যে কোটা আছে, তারও মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ।
গত রোববার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠকে করেছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র সব সংসদ সদস্যই তাঁর। একটা ডান হাত, অন্যটা বাঁ হাত।
আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁদের চিন্তাও একই রকম। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদেরও বেশির ভাগ এমন মনোভাব পোষণ করেন। কারণ, তাঁরা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থেকে দলের কৌশল অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাঁরা দলেই বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রেখে আরও ভালো করতে চাইবেন। এমনটা জানিয়েছেন জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দুজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য।
তবে আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর নেতাদের যাঁরা নৌকা প্রতীকে ভোট করে পরাজিত হয়েছেন, এমন দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁদের শরিকদের মধ্যে এই সংসদ নিয়ে হতাশা রয়েছে। এই হতাশা অবশ্য কার্যকর বিরোধী দল থাকা না থাকার প্রশ্নে নয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের মাত্র ছয়টি আসনে ছাড় দেওয়ায় শরিকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। এরপর নৌকা প্রতীকে ভোট করে মাত্র দুটি আসনে জয়ী হয়েছেন তাঁরা। শরিকদের হতাশা আরও বেড়েছে। অসন্তুষ্টি থাকলেও সংসদে শরিক দলের দুজন সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের বাইরে স্বাধীনভাবে অবস্থান নিতে পারবেন না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্ এই সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় কাউকে দেখেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদে বিরোধী দল দেখছি না। কারণ, জাপাকে বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতার আসনে ভোট করে জিতে এসেছে। আসন সমঝোতার সংসদের যে অবয়ব দাঁড়িয়েছে, তাতে জাপার পক্ষে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ভোট বর্জন ও আন্দোলনের মুখেও নির্বাচন করতে পারায় সন্তুষ্টি রয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। দলটির জ্যেষ্ঠ একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এবার সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পাশাপাশি স্বতন্ত্র সদস্যদের সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ দেবে আওয়ামী লীগ। ফলে আগের দুটি সংসদের চেয়ে নতুন সংসদে কার্যকর বিরোধিতা থাকবে বলে তিনি মনে করেন। যদিও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দলের লোক হিসেবেই বিবেচনা করছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন বিরোধী দলের আসনে বসেছে, তখনো সংসদে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে এখন একপক্ষীয় সংসদে বিরোধী দলের নামে যারা থাকছে, তারা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এ নিয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে।এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গত একাদশ জাতীয় সংসদের সঙ্গে তুলনা করলে ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ওই সংসদে বিএনপির অন্তত পাঁচজন সংসদ সদস্য ছিলেন। ওই নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও বিএনপির পাঁচজন সদস্যই সংসদে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বরে বিএনপি সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর আগ পর্যন্তু তাঁরা সংসদে সোচ্চার ছিলেন। গত সংসদে ২২টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টিই ছিল বিরোধী দলের আসনে। তখন তারা ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এবার সংসদেই নেই বিএনপি।
এর আগে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলেও চতুর্থ সংসদে বিরোধী দলের ক্ষেত্রে ‘গৃহপালিত’ বিশেষণ জুটেছিল। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সেই সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল মাত্র ছয়টি দল। জাতীয় পার্টি ২৫২টি আসন পেয়ে সংসদ বসেছিল। তখন সংসদ নেতা হয়েছিলেন মওদুদ আহমদ। আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে জাসদের একাংশ ও বিভিন্ন ছোট ছোট দল ১৮টি আসন পেয়েছিল। এই দলগুলোর সমন্বয়ে সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন আ স ম আব্দুর রব। চতুর্থ সংসদের এই বিরোধী দল তখন ‘গৃহপালিত’ বিশেষণ পেয়েছিল।
২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। সেই সরকারে আ স ম আব্দুর রবকে নৌপরিবহনমন্ত্রী করা হয়েছিল। কারণ, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬টি আসন। আর বিএনপি ১১৬টি, জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন এবং জাসদের একাংশের নেতা আ স ম আব্দুর রব ১টি আসন পেয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। সেই সরকারে জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে করা হয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রী।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থেকে দলের কৌশল অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাঁরা দলেই বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রেখে আরও ভালো করতে চাইবেন। এমনটা জানিয়েছেন জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দুজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য।
এখন বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি গত সংসদে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসিবে পরিচিতি পেয়েছিল। নতুন সংসদে আগের পরিচিতি থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় পার্টি কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, কোনো সরকারই সংসদকে জবাবদিহিমূলক করার সদিচ্ছা দেখায়নি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন বিরোধী দলের আসনে বসেছে, তখনো সংসদে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে এখন একপক্ষীয় সংসদে বিরোধী দলের নামে যারা থাকছে, তারা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এ নিয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে।