দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই মাস পর আগামীকাল শনিবার অনুষ্ঠিত হতে হচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এর মধ্যে চারজন প্রার্থীর অংশগ্রহণে কুমিল্লায় মেয়র পদের ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার।
ভোটার ও স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নানা হিসাব-নিকাশে এই ভোটে সবার চোখ মূলত বাহারের দিকে।
কুমিল্লার রাজনীতি ও ভোটের পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত মেয়েকে প্রার্থী করায় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার এবং অন্য তিন প্রার্থী মনিরুল হক (সাক্কু), মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন (কায়সার), নূর-উর রহমানের (তানিম) জন্য রাজনৈতিক পরীক্ষা হবে। এই পরীক্ষায় পাস-ফেলের ওপর নির্ভর করবে তাঁদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এবার চতুর্থবারের মতো মেয়র পদে ভোট হচ্ছে। আগামীকাল শনিবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে। ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন। কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৫। এ নির্বাচনে মেয়র পদে চারজন প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা হলেন তাহসীন বাহার (বাস), মো. মনিরুল হক সাক্কু (টেবিলঘড়ি), মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া) ও নূর–উর রহমান মাহমুদ তানিম (হাতি) প্রতীক। মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিন বিএনপি ঘরানার। আর তাহসীন বাহার ও নূর-উর রহমান আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে মাইকিং করেছি। নির্ভয়ে ভোট দিতে আসতে বলেছি। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। নগরের ২৭টি ওয়ার্ডে ভোটের দিন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। কোনো ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গ্রামের ভোটাররা কোনোভাবেই ভোটের দিন সিটি করপোরেশনের ভোটকেন্দ্রের আশপাশে থাকতে পারবেন না। পথে পথে ভোটারদের বাধা দিলেই শাস্তি হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্রের রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তি বাহাউদ্দিনের জন্য এবার মেয়র পদের উপনির্বাচন মর্যাদা রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দলের অনেক উপযুক্ত নেতাকে বাদ দিয়ে মেয়ে তাহসীনকে তিনি প্রার্থী করিয়েছেন। মেয়ের হার বাহাউদ্দিনের পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে কুমিল্লায় বাহাউদ্দিনের একক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্যে চির ধরতে পারে। আর তাতে বাহাউদ্দিনের রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন হতে পারে।
অন্যদিকে বাহাউদ্দিনের মেয়ে তাহসীন বাহারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এবার মুখোমুখি হয়েছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর-উর রহমান। একসময় বাহাউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল। বহুদিন থেকে রাজনৈতিকভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন দুই নেতার ভোটের মাঠে মুখোমুখি হওয়াটা সামনে কতটা সুখকর হয়, তারও একটি পরীক্ষা এই নির্বাচন। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নূর-উর রহমানকে কোণঠাসা করার অভিযোগ আছে। এবারের ভোটে ভালো করতে না পারলে নূর-উর রহমানের রাজনৈতিক অবস্থান আরও দুর্বল হতে পারে।
ভোটার এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোট সুষ্ঠু হলে শেষ পর্যন্ত দুবারের মেয়র মনিরুল হক ও তাহসীন বাহার হবেন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। গতবারের মতো এবারও ভালো ভোটে পরের অবস্থানে থাকতে পারেন নিজামউদ্দিন কায়সার। সিটি করপোরেশনের চারবারের নির্বাচনেই মনিরুল হক মেয়র পদপ্রার্থী। নিজামউদ্দিনও গতবার মেয়র পদে প্রার্থী হয়ে ২৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তাঁরা দুজনই বিএনপির নেতা ছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে গতবার মেয়র পদে নির্বাচন করায় বিএনপি দুজনকেই বহিষ্কার করে। সে বহিষ্কারাদেশ এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। এবারও বিএনপি নির্বাচন করছে না। তবু তাঁরা দুজন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘দলীয় গন্ধ’ নিয়ে এবারও নির্বাচন করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ নির্বাচন মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিন—দুজনের জন্যই রাজনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারণ, নিজামউদ্দিন বিএনপি–সমর্থকদের ভোট কাটায় মনিরুল হক মাত্র ৩৪৩ ভোটে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হকের (রিফাত) কাছে পরাজিত হন। এবার নির্বাচনে যিনি জয়ী হবেন, বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হবে। হারলে দলে ফেরাটা কঠিন হয়ে উঠবে। বিশেষ করে এবার হেরে গেলে মনিরুল হক কুমিল্লার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন বলে আলোচনা আছে।
নিজামউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমিল্লায় বাহার (সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন) ও সাক্কু সাহেব (মনিরুল হক) মিলে কাজ ভাগাভাগি করতেন। আশা করি নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে নয়, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে কুমিল্লায় ভালো নির্বাচন করবে।’
কুমিল্লা সিটির মেয়র নির্বাচনে সবার নজর কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও সেনানিবাস এলাকা) আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের দিকে। বাবার ওপর ভর করেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চান মেয়ে তাহসীন বাহার। কুমিল্লায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই সংসদ সদস্য নিজেই মেয়ের নির্বাচন পরিচালনা করছেন। বাহাউদ্দিন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর মেয়ে তাহসীন বাহার সাংগঠনিক সম্পাদক। বাহাউদ্দিন প্রায় চার দশক কুমিল্লায় ভোটের রাজনীতিতে বড় প্রভাবক। একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আফজল খানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। সিটি করপোরেশনের প্রথম দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আফজল খান ও তাঁর মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা। কথিত আছে, তাঁদের পরাজয়ে বাহাউদ্দিনের ভূমিকা ছিল। তখন তিনি মেয়র প্রার্থী মনিরুল হকের সঙ্গে ছিলেন। দুজনের সমঝোতায় চলত সিটি করপোরেশন। ২০২২ সালে বাহাউদ্দিন তাঁর অনুগত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হককে প্রার্থী করে জিতিয়ে আনেন। তখন আচরণবিধি না মানায় তাঁকে নির্বাচন কমিশন চিঠিও দেয়। আরফানুলের মৃত্যুতে দেড় বছরের মাথায় মেয়র পদে উপনির্বাচন হচ্ছে। এবার বাহাউদ্দিন তাঁর বড় মেয়ে তাহসীন বাহারকে প্রার্থী করে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মেয়ের প্রচারণায় মাঠে নামেন, মতবিনিময় সভা করেন। এ জন্য গত সোমবার রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁকে প্রচারণায় অংশ নিতে বারণ করে চিঠিও দেন।
টেবিলঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী মো. মনিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবারও ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফেল করানো হয়েছে। এবার ওনার (বাহাউদ্দিন) মেয়ে প্রার্থী হইছে। উনি সব শক্তিই প্রয়োগ করছেন। আমার হোটেল, উঠান বৈঠক ও এক কর্মীর বাড়িতে হামলা–ভাঙচুর করিয়েছেন।’
নানা অভিযোগ
তাহসীন বাহার বলেন, ‘তিন প্রার্থীর অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। আমরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করিনি। সুষ্ঠু ভোটে আমার বাস প্রতীক জিতবে। আমি স্মার্ট পরিকল্পিত কুমিল্লা গড়ে তুলব।’
অন্য প্রার্থীদের অভিযোগ, এরপরও সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বসে ছোট ছোট সভা করে নির্বাচন পরিচালনা করছেন। তাঁর বলয়ের ও নির্বাচনী এলাকার বেশির ভাগ শিক্ষক নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। সিটি করপোরেশন এলাকার লাগোয়া কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে জড়ো করে শক্তি প্রদর্শন করতে পারেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। এসব কারণে হতাশা, শঙ্কা, উদ্বেগ ও আতঙ্ক নিয়ে সবার চোখ বাহাউদ্দিনের দিকে।
মেয়র পদপ্রার্থী নূর–উর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একজন প্রভাবশালী নেতাকে (বাহাউদ্দিন) কোনোভাবেই থামাতে পারছি না। আজকে যদি নির্বাচন কমিশন থামাতে না পারে, তাহলে নির্বাচন কতটুকু সুন্দর হবে—সেটা বলা মুশকিল।’
অবশ্য স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, এ নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির ইস্যু বিবেচনায় আসবে না, স্থানীয় রাজনীতিই প্রাধান্য পাবে। জয়-পরাজয় নির্ধারণে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, সাংগঠনিক বিস্তৃতি, তরুণ, সংখ্যালঘু ও জামায়াতের ভোট প্রভাব ফেলতে পারে।