নির্বাচন সামনে রেখে সক্রিয় ‘কিংস পার্টি’, পেছনে ক্ষমতাসীনেরা 

ছোট কিছু দলকে সক্রিয় করে সেগুলোতে বিএনপির দলছুটদের ভেড়ানোর তৎপরতা চলছে। 

রাজনীতি
প্রতীকী ছবি

তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ, বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি—কম পরিচিত এসব দলও এবার জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ধরনের দলগুলোতে বিএনপির দলছুট নেতারা ভিড়বেন এবং তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন—এমন একটা পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এগোচ্ছে। এরই মধ্যে এমন কিছু দল বা ‘কিংস পার্টি’ সক্রিয় হয়েছে। সরকারের সমর্থনে ইসলামি কিছু দলকেও মাঠে নামানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

দলটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য এখন যথাসময়ে নির্বাচন করা এবং সেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। সে জন্য সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ভোটে অংশ নেবে না, এটা ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সরকার ও আওয়ামী লীগের দিক থেকে ছোট কিছু দলকে সক্রিয় করে বিএনপির দলছুটদের ভেড়ানোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এ ধরনের দলগুলোকে ‘কিংস পার্টি’ বলে অভিযোগ করা হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

আওয়ামী লীগ অপেক্ষায় আছে। বিএনপির কারা ভিড়তে পারেন, আগামী মাসের শেষের দিকে তা অনেকটা স্পষ্ট হতে পারে। প্রয়োজন হলে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ ও বিএনএমের সমন্বয়ে একটি জোটের ধারণা নিয়েও আলোচনা আছে।

বিএনপির নেতারা কিছুদিন ধরে অভিযোগ করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে কিছু কিংস পার্টি গঠন করে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে সরকার। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে বিএনপির সাবেক দুই নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারের তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে আসার ঘটনা। যদিও তৃণমূল বিএনপিসহ নতুন সক্রিয় হওয়া এসব দল কিংস পার্টির অভিযোগ অস্বীকার করছে।

তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন আলোচনাও রয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে জাতীয় পার্টি, ১৪ দলের শরিক এবং বিএনপি থেকে ছেড়ে আসা নেতা ও ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ১০০ আসনে ছাড় দেওয়া হতে পারে। ভোটে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে ভোট অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে দেশে-বিদেশে দেখানো যাবে। ফলে ভোট টানতে পারে এমন দল ও ব্যক্তিকে আগামী নির্বাচনে দরকার।

কম পরিচিত কিছু দল এবার জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

■ ভোটে আনার জন্য রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন সরকারের লোকজন।

■ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র অবশ্য বলছে, বিভিন্ন ইসলামি দল ও বিএনপি থেকে নেতাদের নির্বাচনে টানার দায়িত্ব একক কোনো রাজনীতিকের ওপর নেই। সরকারের ভেতরে এ ব্যাপারে কাজ চলছে। এই কাজের অগ্রগতি মাঝেমধ্যে তিনজন মন্ত্রীকে অবহিত করা হয়।

সূত্র আরও বলছে, ভোটে আনার জন্য যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, তাঁদের ব্যক্তি হিসেবে বা একেক দলকে একেক রকম সুবিধার কথা বলা হচ্ছে। কেউ আর্থিক সুবিধা চাইছেন, তাঁদের সেই আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। অনেকের লক্ষ্য জনপ্রতিনিধি হওয়া, তাঁদের মাঠের শক্তি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে সেই আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত অনেকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে ভোট করার কথা ভাবছেন।

সুনির্দিষ্ট কারও নাম বলতে না চাইলেও সূত্র বলছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে যাঁদের লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকেই অতীতে সংসদ সদস্য ছিলেন। অনেকে রাজনৈতিক জীবনের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তাঁদের জীবনে হয়তো আর সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকবে না।

তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ ও বিএনএম

তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ ও বিএনএমের সূত্রগুলো বলছে, তাদের সঙ্গে এর মধ্যে আওয়ামী লীগের হয়ে কোনো কোনো পক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। বিএনপির বড় নেতারাও ভিড়তে পারেন, এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে নতুন কেউ এলে দলের পদ-পদবি ছেড়ে দিতে হতে পারে—এমন বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।

সুনির্দিষ্ট কারও নাম বলতে না চাইলেও সূত্র বলছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে যাঁদের লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকেই অতীতে সংসদ সদস্য ছিলেন। অনেকে রাজনৈতিক জীবনের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তাঁদের জীবনে হয়তো আর সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকবে না। অনেকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুদৃষ্টিতে নেই। ফলে ভবিষ্যতে তাঁদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়াও অনিশ্চিত। বিএনপির এসব নেতার কেউ কেউ আগ্রহও দেখিয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির উঠতি জেলা পর্যায়ের কিছু নেতাও রয়েছেন, যাঁদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে থাকলে তাঁদের সেই সম্ভাবনা নেই, এমনটাই বোঝানো হচ্ছে।

তবে বিএনপির অধিকাংশ নেতাই আরও সময় নিতে চাইছেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর কেউ কেউ আরও ভাবতে চাইছেন। তবে আওয়ামী লীগ অপেক্ষায় আছে। বিএনপির কারা ভিড়তে পারেন, আগামী মাসের শেষের দিকে তা অনেকটা স্পষ্ট হতে পারে। প্রয়োজন হলে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ ও বিএনএমের সমন্বয়ে একটি জোটের ধারণা নিয়েও আলোচনা আছে।

গত ১০ আগস্ট নিবন্ধন পাওয়ার পর সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে এ মাসেই ছয় দল নিয়ে একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জোটের অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল। দুজনই আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

বিএনপি থেকেই সৃষ্টি তিন দলের

২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংসদে বাতিল হওয়ার পর আন্দোলনে নামে বিএনপি। পরের বছর গঠিত হয় বিএনএফ। এর উদ্যোক্তা ছিলেন বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা এবং বিএনপিরই একসময়ের নেতা আবুল কালাম আজাদ। অচেনা দলটি ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার পর ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আলোচনায় আসে। দলটি বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষের মতো দেখতে ‘গমের শীষ’, পরে ‘ধানগাছ’ প্রতীক চায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তারা টেলিভিশন প্রতীক পায়। একপর্যায়ে নাজমুল হুদাকে বহিষ্কার করেন দলটির প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ। ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন ভোটে আবুল কালাম আজাদ গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার সংসদ সদস্য হন।

বিএনএফের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে যোগ দেওয়ার জন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

বিএনএফ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (বিএনএ) ও বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি (বিএমপি) নামে দুটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন নাজমুল হুদা। ২০১৫ সালে তিনি গঠন করেন ‘তৃণমূল বিএনপি’। গত ফেব্রুয়ারিতে দলটি নিবন্ধন পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান নাজমুল হুদা। এরপরই বিএনপির সাবেক নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার দলটির শীর্ষ পদে এলেন।

এবার কম পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়ে আলোচনার জন্ম দেয়। সুপ্রিম পার্টি চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারী দরবারকেন্দ্রিক দল। আর বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুর রহমান। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বরগুনা-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে জয়ী হয়েছিলেন। দলে আটজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন।

ইসলামি দলেও চোখ

গত ১০ আগস্ট নিবন্ধন পাওয়ার পর সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে এ মাসেই ছয় দল নিয়ে একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জোটের অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল। দুজনই আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। জোট গঠন করেই তাঁরা শেখ হাসিনার অধীন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন।

এর বাইরে জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (মতিন) নিয়ে আরেকটি জোটের তৎপরতা চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এই দলগুলো আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে বলে তাঁরা মনে করছেন। তিনি আরও বলেন, ভোট বর্জন করলে বিএনপির বহু নেতা বেরিয়ে এসে ভোট করবেন। এর বাইরে অন্যান্য ইসলামপন্থী দল ও জাতীয় পার্টিও ভোটে অংশ নেবে। 

তবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের মীমাংসার কোনো লক্ষণ এখনো নেই। বিএনপি ও এর সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলো যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের বাইরে থাকে, তাহলে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ বা মিত্র হিসেবে পরিচিত কিছু দল এবং কিংস পার্টির অংশগ্রহণে নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

এদিকে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন এবং নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন।