মেয়র হবে লাঙ্গলের, দ্বিতীয় হবে নৌকা—রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল নিয়ে এমন ধারণাই ছিল অধিকাংশের। এলাকা রংপুর বলেই এমন ধারণা হয়তো ছিল অনেকের। কিন্তু সব হিসাব উল্টে গেছে ভোটের ফলাফলে। নৌকার প্রার্থী চতুর্থ হয়ে জামানত হারিয়েছেন। এমন ফলাফলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের বছরখানেক আগে নৌকার এমন ফলাফল দলের জন্য ভালো হবে না। আওয়ামী লীগের প্রাথী নির্বাচন, অঙ্গসংগঠনসহ নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ভরাডুবির পেছনে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা হাতপাখার ৫০ হাজার ভোট পাওয়া নিয়েও চিন্তিত।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমানের কাছে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা (ডালিয়া)। এ পরাজয়ের চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে নৌকার ভোটের সংখ্যা নিয়ে। নৌকা পেয়েছে ২২ হাজার ভোট, অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পেয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমানও নৌকার চেয়ে ১১ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন।
দলের স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন সঠিক হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা জনগণের কাছে পরিচিত নন। যাঁরা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাঠে ছিলেন, দল থেকে তাঁদের কাউকে মনোনয়ন দিলে ফল ভালো হতো। হোসনে আরার পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাঠেও ছিলেন না।
দলীয় প্রার্থীর এমন ফলাফলের বিষয়ে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা এমন ফলাফলে আশাহত। মানুষ ভোট দেওয়ার আগে দেখেন, প্রার্থী তাঁদের পাশে থাকেন কি না। যাঁদের সব সময় পথেঘাটে দেখেন, এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ভোটের এমন ফল রংপুরে আওয়ামী লীগকে আরও পিছিয়ে দেবে। এ ফলাফল থেকে দলের সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত।
২০১২ সালের ২৮ জুন রংপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। এরপর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর। নির্দলীয় সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী সরফুদ্দীন আহমেদ ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান। তিনি পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট।
২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নির্বাচনে প্রায় ১ লাখ ভোটের ব্যবধানে জয় লাভ করেন জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান। লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে তিনি পান ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট। নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের সরফুদ্দীন আহমেদ পান ৬২ হাজার ৪০০ ভোট।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, জনপ্রিয়তার দিক থেকে রংপুরে মোস্তাফিজার রহমান হেভিওয়েট প্রার্থী। সে তুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী জনপ্রিয় কেউ নন। রংপুরে নৌকার নিজস্ব কিছু ভোট আছে। সেসব ভোটও টানতে পারেননি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আগের নির্বাচনের চেয়ে এবার প্রায় ৪০ হাজার ভোট কম পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী।
এবার নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নেন মোট ৯ প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা জামানত টিকিয়ে রেখেছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীসহ সাত প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। জামানত টেকাতে মোট বৈধ ভোটের আট ভাগের এক ভাগ থেকে অন্তত একটি ভোট বেশি পেতে হয়। সে হিসাবে হোসনে আরাকে অন্তত ৩৪ হাজার ৩৯৩টি ভোট পেতে হতো। কিন্তু তিনি পেয়েছেন ২২ হাজার ৩০৬ ভোট।
হোসনে আরার নিজ কেন্দ্র জি এল রায় রোডে অবস্থিত লায়নস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র। সেখানেও তিনি হেরেছেন। এই কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন ৯২ ভোট। জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান পেয়েছেন ১৬৬ ভোট। এই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান পেয়েছেন ১৪৪ ভোট।
দলের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণেও নৌকার ভোট কমেছে। কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি লতিফুর রহমান হাতি প্রতীক নিয়ে লড়েন। তিনি পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। নৌকার ভোট কাটাকাটি হয়েছে দলের প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে।
দলের একাধিক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু চরমোনাইয়ের তো কোনো ঘাঁটি না। হাতপাখা কীভাবে ৫০ হাজার ভোট পায়? আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এই ফলাফল ভালোভাবে নিতে পারছেন না। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র বছরখানেক আগে নৌকার এমন অবস্থান দলের জন্য ভালো হবে না।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভোট ব্যবধান বেড়েছে। প্রাথী নির্বাচন, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনসহ নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, পরিকল্পনার অভাব ও প্রচারে শৈথিল্য নৌকার ভরাডুবির পেছনে কাজ করেছে।