আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশল নিয়ে নাখোশ দলীয় প্রার্থীরা 

  • আওয়ামী লীগের ‘স্বতন্ত্র কৌশল’ তৃণমূলে একটা স্থায়ী বিভক্তি তৈরি করতে পারে।

  • ৭০-৮০টি আসনে দলীয় প্রার্থীকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। 

  • প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বরের পর স্বতন্ত্র কৌশলে কিছুটা বদল আসতে পারে।

আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার কৌশল নিয়ে নাখোশ দলের মনোনীত প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে নৌকা প্রতীক নিয়েও হেরে বসতে পারেন অনেকে—এমন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে; আছে সংঘাতের আশঙ্কাও। নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করছেন, এর মাধ্যমে দলের তৃণমূলে একটা স্থায়ী বিভক্তি তৈরি হতে পারে। যা জোড়া লাগাতে হিমশিম খেতে হবে। 

এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাতে শরীয়তপুর-২ আসনের নড়িয়া এলাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণে দুই পক্ষের অন্তত পাঁচজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক, মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কোনো আসনে দলের মনোনীত প্রার্থীরা অনেকটা একা হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের দুশ্চিন্তা, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাঁদের অনেককে চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারেন। তাঁদের মধ্যে আছে সংঘাতের আশঙ্কাও।

শরীয়তপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র
জমা দিয়েছেন যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খালেদ শওকত আলী। তিনি এই আসনের প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর ছেলে। এই দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। 

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক, মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কোনো আসনে দলের মনোনীত প্রার্থীরা অনেকটা একা হয়ে পড়েছেন। কারণ, দলের নেতৃত্বস্থানীয় প্রায় সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আবার কোথাও কোথাও মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে বর্তমান সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এমন জটিল পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও বিভক্ত হয়ে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

মন্ত্রিসভার একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, কে জিতবে কে হারবে, সেটা পরের বিষয়। কিন্তু দলের তৃণমূলে স্থায়ীভাবে একটা ক্ষত তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ১৭ ডিসেম্বরের পর স্বতন্ত্র কৌশলে কিছুটা বদল আসতে পারে। তবে সেই বদলটা কী, তা এখনো স্পষ্ট নয় নেতাদের কাছে।

‘স্বতন্ত্র কৌশল’ পরিবর্তনের অপেক্ষায় প্রার্থীরা 

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মত হচ্ছে, স্বতন্ত্র কৌশলের পেছনে দুটি লক্ষ্য কাজ করেছে। প্রথমত, একসঙ্গে অনেক প্রার্থী নামিয়ে দিয়ে নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি করে বিএনপিসহ বিরোধীদের অবরোধ কর্মসূচি ভোঁতা করে দেওয়া।

 দ্বিতীয়ত, ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কারণ, জাতীয় পার্টি ও অন্য কোনো দল যদি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে, তখন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হারাবে, ভোটার উপস্থিতি কমে যাবে। এটাকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তা মোকাবিলা করার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা হচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ১৭ ডিসেম্বরের পর স্বতন্ত্র কৌশলে কিছুটা বদল আসতে পারে। তবে সেই বদলটা কী, তা এখনো স্পষ্ট নয় নেতাদের কাছে। কেউ কেউ মনে করেন, এমন একটা নির্দেশনা আসতে পারে যে দলের পদধারী কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন না। এমন নির্দেশনা এলে অন্তত অর্ধেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন। তবে সবাই এ নির্দেশনা মানবেন কি না, সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন।

কিন্তু অতীতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচনে বহিষ্কার করার পরও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী। সর্বশেষ গত মে মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিপক্ষে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে জয়ী হন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করার পরও তিনি দমে যাননি।

জায়েদা খাতুন জয়ী হওয়ার পর নতুন মেয়রকে ‘ঘরের লোক’ অভিহিত করে অভিনন্দন জানান দলের নেতারা। পরে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কার আদেশ তুলে নেওয়া হয়। এবার জাতীয় নির্বাচনও ‘গাজীপুর মডেলে’ হতে যাচ্ছে বলে দলে আলোচনা রয়েছে।  

সারা দেশে আওয়ামী লীগের ৪৪২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, সারা দেশে ৭০-৮০টি আসনে দলীয় প্রার্থীকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। 

এর মধ্যে অন্যতম ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ ও মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের লড়াই গত এক দশকের। গত দুটি নির্বাচনে কাজী জাফর উল্যাহ দলীয় মনোনয়ন পেয়েও মজিবুর রহমান চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। এবার কাজী জাফর উল্যাহ দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন। অন্যদিকে দুবার দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে ২০২০ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন মজিবুর রহমান চৌধুরী।

এবার আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা ছিল, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হওয়ার পর হয়তো কাজী জাফর উল্যাহ নির্বাচন করবেন না। কিন্তু তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। যথারীতি স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মজিবুর রহমান চৌধুরী। ইতিমধ্যেই জাফর উল্যাহ ও মজিবুর রহমান চৌধুরীর মধ্যে কথার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। 

বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এই আসনে আরেক ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন রিপন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিটি করপোরেশনের বাইরে সদর উপজেলার ইউনিয়নগুলোতে কাজ করছেন। এই আসনেও কেউ কাউকে ছাড় দেবেন বলে মনে হয় না। 

আর ফরিদপুর-৩ আসনে খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা সভাপতি শামীম হককে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাঁর বিপক্ষে নির্বাচন করছেন ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ। এ কে আজাদ দীর্ঘদিন ধরে ওই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। আর শামীম হক নতুন প্রার্থী। ফলে এখানেও লড়াই দেখছেন স্থানীয় লোকজন। 

খন্দকার মোশাররফের মতো তাঁর জামাতা হাবিবে মিল্লাত বাদ পড়েছেন সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জান্নাত আরা হেনরী। হাবিবে মিল্লাত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় সূত্র বলছে, জান্নাত আরাকে ভালোই চ্যালেঞ্জ জানাবেন হাবিবে মিল্লাত। 

কুমিল্লা-৬ আসনে আফজল খান ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। আফজল খান মারা যাওয়ার পর সন্তানদের মধ্যেও সেই দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এই আসনে দলীয় প্রার্থী বাহাউদ্দিনের সঙ্গে লড়বেন আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা। তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। বাহার মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সীমা সহসভাপতি। কিন্তু দুজন আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন। 

৭১ জন সংসদ সদস্য এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-১২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, বরিশাল–৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথসহ ৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দলটির নেতারা বলছেন, বর্তমান সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকায় তাঁদের একটা প্রভাব রয়ে গেছে। ফলে দলীয় প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ হবেন তাঁরা। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে দল থেকে নির্দেশনা আসবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।