বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

উপজেলা নির্বাচন

মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের স্বজনেরা এখনই সরছেন না, সময় নিতে চান

দলের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পরও মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের স্বজনেরা এখনই ভোট থেকে সরছেন না, তাঁরা সময় নিতে চাইছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নিকটাত্মীয়দের কেউ ভোট থেকে সরে না দাঁড়ালে বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এরপরও মন্ত্রী-সংসদ সদস্য যাঁরা সন্তান ও স্বজনদের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন, তাঁদের অনেকে বলেছেন, দল আসলে কতটা কঠোর হবে, সেটা তাঁরা বোঝার চেষ্টা করছেন। সে জন্য তাদের স্বজনেরা ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নে নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সময় নেবেন।

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিজের ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়নকাজ না করার হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। নাটোরে লুৎফুল হাবিবের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। এসব খবরসহ নানা বিভেদের তথ্য দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ডেকে উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন বলে দলটির সূত্রগুলো বলছে।

আগামী ৮ মে প্রথম পর্বে ১৫০টি উপজেলায় ভোট হবে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে প্রথম পর্বে ১৪টি উপজেলায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়রা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্যান্য পর্বের নির্বাচনেও অনেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য তাঁদের স্বজনদের প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত উপজেলা নির্বাচনের চার পর্বের জন্যই প্রযোজ্য বলে বলা হয়েছে।

দলের প্রধানের নির্দেশনা পেয়ে ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবারই সকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। সেই বৈঠকের পরই বিভিন্ন বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকেরা মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের দলের নির্দেশনা জানিয়ে দেন। গতকাল তাৎক্ষণিকভাবেই মাদারীপুর সদরের সংসদ সদস্য ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এবং নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরীকেও ফোন করে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক। এই দুই স্থানে সংসদ সদস্যের ছেলেরা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। সংসদ সদস্যরা সন্তানদের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করছেন।

গতকালই এক বিবৃতিতে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরা যাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সে জন্য কঠোর সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নিজের অভিযোগের জবাবের অপেক্ষায় একরাম

সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সাংগঠনিক নির্দেশনা পেয়েছেন। দলীয় প্রধান বললে তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত মানবেন। তবে তাঁর দাবি, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে তাঁর ছেলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোট করা বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন। এর বিচার চেয়ে কেন্দ্রে নালিশ দিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে কী জবাব আসে, সেই অপেক্ষায় আছেন তিনি।

স্বজন ও আত্মীয় নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা

উপজেলা নির্বাচনের মাঠে থাকা মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও তাঁদের স্বজনেরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পরও সময় নিতে চাইছেন। প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলার ভোটের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২২ এপ্রিল। ওই দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে চান তাঁরা। তাঁদের দাবি, আত্মীয়স্বজনের সীমা কত দূর পর্যন্ত যাবে, এ বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়নি। এ ছাড়া অনেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের আত্মীয় বর্তমানে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তাঁরা পুনরায় ভোট করতে চাইলে তাঁদেরও সরে দাঁড়াতে হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকে। আবার এভাবে প্রার্থী বসে গেলে কোথাও কোথাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ারও সুযোগ তৈরি হতে পারে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, যাঁরা স্বজনদের প্রার্থী করছেন, তাঁদের তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কাল শনিবারের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। সেই তালিকা পর্যালোচনা করে দূরের স্বজনদের কারও কারও ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, ভাই-বোন কিংবা শ্যালক—এসব নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থানে দল।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী। এর আগে তাঁর স্ত্রী আয়েশা ফেরদৌস দুবার সংসদ সদস্য ছিলেন। এবার উপজেলা ভোটে স্ত্রী এবং ছেলে আশিক আলীকে প্রার্থী করেছেন। তবে আয়েশা ফেরদৌসকে ‘ডামি’ প্রার্থী মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।

গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কেন্দ্রের নির্দেশনা পেয়েছেন। তবে তিনি অপেক্ষা করছেন। সময়ই বলে দেবে কী করতে হবে।

নীলফামারীর ডিমলায় সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের চাচাতো ভাই আনোয়ারুল সরকার এবং ভাতিজা ফেরদৌস পারভেজ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোট করছেন। এখানে বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুল ইসলাম।

সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ভাতিজা ও চাচাতো ভাইয়ের প্রার্থী হওয়া নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধিতা করছেন। এখন দল যেহেতু সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা সবাই মানবেন বলে মনে করেন।

বিএনপিবিহীন ভোট প্রভাবমুক্ত রাখা লক্ষ্য

আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, দলের নেতাদের দাবির মুখে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়নি। মূল লক্ষ্য ছিল সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের ভোটে দাঁড় করিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। এটা পছন্দ করছেন না দলের প্রধান শেখ হাসিনা। তিনি কঠোরভাবে প্রভাবমুক্ত নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা যাতে প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে না পারেন, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকেও নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জন করেছে। তাদের প্রার্থীরা বিপুল সংখ্যায় ভোটে অংশ নেবেন বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা প্রভাব বিস্তার করলে আর ভোট থাকবে না। সংঘাতেরও আশঙ্কা রয়েছে। যা দেশে-বিদেশে সমালোচনার জন্ম দেবে। জাতীয় নির্বাচনের পরপরই এ ধরনের বদনাম নিতে রাজি নন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা।

দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে নিজের প্রভাব বাড়ানোর জন্য মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও ‘মাই ম্যান’ তৈরি করার লক্ষ্যেও পছন্দের প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামছেন। এতে দলের তৃণমূলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ জন্যই এই কড়া অবস্থান।

কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ৩০ ওপ্রিল

২ মে সংসদের আগামী অধিবেশন বসছে। অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকা হতে পারে। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে তাঁর অবস্থান তুলে ধরবেন। এ ছাড়া ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেরও বৈঠক হতে পারে। সেখানেও বিষয়টি আলোচিত হবে। নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলে সরাসরি বহিষ্কারের বিধান রয়েছে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, দলের সভাপতি স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। কেউ সিদ্ধান্ত অমান্য করলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।