বিএনপি কী কর্মসূচি দেয়, সেদিকে তাকিয়ে আওয়ামী লীগ

বিরোধী দলের বড় কর্মসূচি না থাকায় এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগও মাঠে কর্মসূচি রাখছে না।

মাসের শুরুতেই ঢাকায় পরপর দুটি বড় সমাবেশ করে একধরনের সন্তুষ্টি কাজ করছে আওয়ামী লীগে। ক্ষমতাসীন দলটি এখন বিরোধী দলের কৌশল দেখার অপেক্ষায়। বিএনপি নতুন করে কেমন কর্মসূচি দেয়, সেদিকেই তাকিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। দলটি বিরোধী দলের কর্মসূচি দেখেই মাঠের কর্মসূচি সাজাতে চায়।

যদিও বিএনপির আন্দোলনে বড় কোনো চাপ অনুভব না করার কথা বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁরা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির অবস্থান থেকে সরে আসার কথাও বলে আসছেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে এই কয়েক মাস আগে মাঠের নিয়ন্ত্রণ বিরোধী দলের হাতে একতরফা ছেড়ে দিতেও রাজি নন ক্ষমতাসীনেরা। ফলে বিরোধী দল পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করলে, সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখানোর কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

মাঠের রাজনীতিতে বিরোধী দলের এক দফার আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি না থাকায় এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগও কর্মসূচি রাখছে না। তবে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘গায়েবি মামলা’ করা হচ্ছে এবং বিরোধী দলের সক্রিয় নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে বিএনপি অভিযোগ তুলেছে। যদিও সরকার এমন অভিযোগ অস্বীকার করছে।

চলতি সেপ্টেম্বরে দলটি ঘুরে দাঁড়িয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে পারবে—এমনটা মনে করছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। অক্টোবরের দিকে হয়তো বিএনপি টানা কর্মসূচি নিতে পারে। তখন আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্মসূচি নেবে।

১ সেপ্টেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশ এবং ২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে সুধী সমাবেশ বিপুল জমায়েত হয়। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এ দুটি সমাবেশের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি দেখানো। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল বলে মনে করেন তাঁরা। সে কারণে তাঁরা এখন কর্মসূচি না রেখে ধীরগতিতে এগোতে চাইছেন। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু সমাবেশ আগেই ঠিক করা ছিল। সেই সমাবেশগুলো তাঁরা করবেন।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঢাকা, ২২ জুলাই

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার বিষয়টি এখন অগ্রাধিকারে নেই আওয়ামী লীগের। বরং দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যেসব সমাবেশে যাচ্ছেন, সেগুলোতে বিপুল জমায়েত নিশ্চিত করা প্রধান লক্ষ্য। একই সঙ্গে দলের নেতাদের প্রস্তুত রাখা, সতর্ক থাকা, স্বল্প সময়ের নির্দেশনায় জমায়েত করার পরিকল্পনাও রেখেছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ঢাকায় একধরনের সতর্ক পর্যবেক্ষণ সব সময় থাকবেই।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা শুনতে চায়। ঢাকার দুটি বড় সমাবেশে মানুষ যেভাবে সাড়া দিয়েছে, এতে বিএনপির অশান্তির রাজনীতি সফল হবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা চলতে থাকবে। তিনি বলেন, আগস্টে টানা কর্মসূচি গেছে। সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক করে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে।

আওয়ামী লীগ রাজপথে চ্যাম্পিয়ন, এটা ঢাকার দুটি সমাবেশে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন

সেপ্টেম্বরে চাপ দেখছে না আওয়ামী লীগ

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন—যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের আয়োজনে শান্তি সমাবেশ হয়। ঢাকা, ২৮ জুলাই

গত ২৮ জুলাই বিএনপি ঢাকার নয়াপল্টনে বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে মহাসমাবেশ করে। ওই দিন আওয়ামী লীগও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে বড় সমাবেশ করে। এরপর বিএনপি মানববন্ধন, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করেছে। এ সময় আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি থেকে বিরত রয়েছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, বিএনপি গত বছর ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে না পেরে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে। এতে দলটির নেতা-কর্মীদের মনোবলে ধাক্কা খায়। এরপর পুনরায় সংগঠিত হতে কয়েক মাস সময় লেগে যায় তাদের। ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি সফল না হওয়ায় এখনো বড় কর্মসূচি নিতে পারেনি বিএনপি। চলতি সেপ্টেম্বরে দলটি ঘুরে দাঁড়িয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে পারবে—এমনটা মনে করছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। অক্টোবরের দিকে হয়তো বিএনপি টানা কর্মসূচি নিতে পারে। তখন আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্মসূচি নেবে।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির হয়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত রয়েছে, এমন সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সুযোগে বিদেশে সফর করছেন কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফরে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ফেরার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বাংলাদেশ সফর করবেন। ১৬ সেপ্টেম্বর সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী, মিরপুর ও গুলশান হয়ে ভাটারা পর্যন্ত মেট্রোরেল পথের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ওই দিন সাভারে সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। সাভারেও ঢাকার সমাবেশের মতো বড় জমায়েত করার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যেই ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন। এই দিনটি আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে পালন করবে। এর বাইরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নির্ধারিত কোনো কর্মসূচি নেই আওয়ামী লীগের। অক্টোবরে সিলেট, বরিশাল ও খুলনায় বিভাগীয় সমাবেশ করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষে ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। অর্থাৎ অক্টোবরে টানা কর্মসূচি রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ রাজপথে চ্যাম্পিয়ন, এটা ঢাকার দুটি সমাবেশে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে।

কূটনীতিতে জোর

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, রাজপথের আন্দোলন দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে পারবে না বিএনপি। বরং সরকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সামনে কূটনৈতিক পর্যায়ে চাপ সামলানোই বড় চ্যালেঞ্জ। সামনের দিনগুলোতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সেদিকেই বেশি নজর দেবে।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির হয়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত রয়েছে, এমন সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সুযোগে বিদেশে সফর করছেন কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে। কারণ, যথাসময়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা আওয়ামী লীগের একমাত্র ও প্রধান লক্ষ্য। বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকর, এটা প্রমাণিত। ফলে বিএনপির পক্ষে ভোট ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে ভোটের আগে ও পরে যাতে কূটনৈতিক চাপ না আসে, সেটা নিশ্চিত করাই বড় বিষয়। এ কাজেই আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী এখন মনোযোগী। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতাদের সফর করা, সমমনা দেশগুলোর কূটনৈতিকদের দেশে আমন্ত্রণ জানানো—এ বিবেচনা থেকেই হচ্ছে।