জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম–বল প্রয়োগের মতো ঘটনায় ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা কমানো হলো। বিরোধী দলের সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে আজ মঙ্গলবার সংসদে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এ–সংক্রান্ত সংশোধনী সংসদে পাস হয়।
জাতীয় নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে ইসির ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়ে বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য অভিযোগ করেন, যেভাবে আইন সংশোধন করা হচ্ছে, তাতে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে না।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে দাবি করেন, ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, ভোট গ্রহণের আগে ইসি চাইলেও এখন আর ভোট বন্ধ করতে পারবে না। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের (সংসদীয়) ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না ইসি। শুধু যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব ভোটকেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে ইসি।
আরপিও সংশোধনের জন্য এ–সংক্রান্ত বিলটি সংসদে তোলার পর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘আরপিরও মধ্যে কতগুলো ক্লজ (ধারা) লাগানো হলো, যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। আমরা জানি, নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলে যেকোনো নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু এই অধিকার খর্ব করা হলো। এখন কী করা হলো? তারা সেন্টারগুলো (ভোটকেন্দ্র) বন্ধ করতে পারবে কিন্তু পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এটা হলে এই ইসি দিয়ে আমরা কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচনটা করব?’
সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য বলেন, আইনে ‘ইলেকশন’ শব্দের স্থলে ‘পোলিং’ শব্দটা এনে বড় পার্থক্য করা হয়েছে। আগের দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বিধানের মাধ্যমে ঋণখেলাপিকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই আইনে যেটা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং এই কমিশন দিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
আপাতদৃষ্টিতে এই আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন বলে সংসদে উল্লেখ করেন গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, দেশে আইন হয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সরকারের স্বার্থে। নির্বাচনের আগে এমন আইন করা হয়। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচনব্যবস্থা এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে মানুষ এখন ভোটবিমুখ। যারা সরকার উৎখাতে আন্দোলন করছে, তারাও এর জন্য কম দায়ী নয়। তারা এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটার করেছিল।
মোকাব্বির খান বলেন, দেশের মানুষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, এর সব কটিই প্রশ্নবিদ্ধ। এ ধরনের নির্বাচন বাংলার মানুষ আর চায় না। মানুষ চায় একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
মোকাব্বির খান বলেন, বিরোধী দলের (বিএনপি) অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের যারা ভোট চোর বলে, তারা হলো ভোট ডাকাত।’ কিন্তু জনগণ ভোট চোর বা ভোট ডাকাতদের খেলার দর্শক হিসেবে আর দেখতে চায় না। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও শুনতে চায় না। জনগণ চায় তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন। সেখানে সে নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
আগে যেখানে পুরো ভোট বন্ধের সুযোগ ছিল, সেটা বন্ধ করে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বলে আলোচনায় উল্লেখ করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, এত দিন আইনে ‘ইলেকশন’ শব্দ ছিল। ইলেকশন বলতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত বোঝায়। সেটা বাদ দিয়ে ‘পোলিং’ যুক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ শুধু ভোটের দিন।
আইনমন্ত্রীর জবাব
বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কয়েকটি কেন্দ্রে ভয়ভীতি বা গন্ডগোল হলে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা গণতান্ত্রিক নয়। এ কারণে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। যেখানে সহিংসতা বা অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো বন্ধ হবে।
আইনমন্ত্রী দাবি করেন, আইনে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি। নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা আছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, বিরোধী দল ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) গ্রহণ করতে চায়নি, সে জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন চিন্তাভাবনা করেই বলেছে ইভিএমে নির্বাচন হবে না।
যেসব সংশোধনী এল
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ (এ) উপধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া বোঝায়। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন। ‘ইলেকশন’ শব্দটি থাকলে ভোটের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারত। কিন্তু সংশোধনী পাসের কারণে ইসির ক্ষমতা খর্ব হলো।
তবে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আরপিওর ৯১ (এ) নিয়ে এত দিন অস্পষ্টতা ছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পর তা ইসির কাছে পাঠানো হয়। ইসি সচিবালয় গেজেট প্রকাশ করে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত ইসি ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সেটি পরিষ্কার ছিল না।
এ কারণে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য ইসি এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকারকে দেওয়া প্রস্তাবে ইসি বলেছিল, কোনো অনিয়ম, জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন দিতে পারবে।
তবে আইনের যে সংশোধনী পাস হলো, তাতে ইসিকে পুরো সংসদীয় আসনের ফলাফল স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আইনে বলা হয়েছে, যেসব ভোটকেন্দ্রে (এক বা একাধিক) এসব অভিযোগ থাকবে, ইসি শুধু সেসব কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন নির্বাচন করতে পারবে।
এ ছাড়া সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে তাঁকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ এবং টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ন্যূনতম সাত দিন আগে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হতো।