পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ নিয়েও দুশ্চিন্তা আওয়ামী লীগের

বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ। ফলে ক্ষমতাসীনেরা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সমস্যা দ্রুত মেটানোর তাগিদ অনুভব করছেন।

মিরপুর–১১ নম্বরে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভমিছিল। আজ বৃহস্পতিবার সকালে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বিএনপিসহ বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের মধ্যে পোশাক খাতের শ্রমিকদের মাঠে নামা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকদের বেশির ভাগেরই ধারণা, এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত এরই মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে এর সুযোগ নিচ্ছে।’

এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত মেটানোর তাগিদ অনুভব করছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত সোমবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার সংসদ সদস্যরা যৌথ সভায় যোগ দেন। সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পোশাক কারখানা আছে—এমন এলাকার সংসদ সদস্যদের কিছু নির্দেশনা দেন।

এর মধ্যে রয়েছে পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানানো যে সরকার নভেম্বরে নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণা করবে। আর তা কার্যকর হবে ডিসেম্বরে। বর্তমান সরকারের আমলেই পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তাই সরকারের ওপর আস্থা রাখার বিষয়ে পোশাকশ্রমিক নেতাদের বোঝানোর নির্দেশনা দেওয়া হয় সংসদ সদস্যদের।

আওয়ামী লীগের ওই সূত্রগুলো আরও জানায়, একই নির্দেশনা দেওয়া হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা এবং স্থানীয় কাউন্সিলর ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের। শ্রমিকদের বুঝিয়ে আন্দোলন থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা ছিল কেন্দ্রের। কিন্তু কেউ কেউ ভয় দেখিয়ে, হামলা করে এবং শক্তির মাধ্যমে আন্দোলন দমাতে চেয়েছে; যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।

গত মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকায় পোশাকশ্রমিকেরা বিক্ষোভে নামলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে মাঠে নেমেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু নামের যুবলীগের এক নেতাকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়। সেই ছবি সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। লাঠিসোঁটা হাতে হামলাও করা হয় পোশাকশ্রমিকদের ওপর। গতকাল বুধবারও ওই এলাকায় পোশাকশ্রমিকেরা মাঠে নামেন।

বুঝিয়ে শান্ত করার কৌশল

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, একই আচরণ পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে করলে হিতে বিপরীত হবে। পোশাক খাত ও এর শ্রমিকেরা স্পর্শকাতর। ফলে তাঁদের সঙ্গে নমনীয় থেকে, বুঝিয়ে শান্ত করতে হবে।

ঢাকার আশপাশের এলাকার একাধিক সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার দলের নির্দেশনা পেয়েই তাঁরা পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা কথা বলেছেন। কারখানার মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়েও বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের নেতৃত্বে কারা, সেটা বের করা কঠিন। তাঁদের অধিকাংশই গুজবে কান দিয়ে মাঠে নেমে পড়েন।

গাজীপুর সিটি ও কালিয়াকৈর নিয়ে গঠিত আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক মোজাম্মেল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পেয়ে তিনি এলাকায় কাজ করেছেন। এখন তাঁর নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ শান্ত আছে। মন্ত্রী উল্লেখ করেন, পোশাকশ্রমিকেরা অনেকেই গুজবে কান দিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁদের বোঝানোর পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।

প্রায় একই কথা জানান উত্তরা এলাকার সংসদ সদস্য হাবিব হাসান। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, পোশাকশ্রমিকদের ওপর ভর করে বিএনপি-জামায়াত সুযোগ নিতে চাইবে। তাঁরা তা হতে দেবেন না।

যৌথ সভায় বসবে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ

আজ বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আরেকটি যৌথ সভা ডাকা হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এতে আরও থাকবেন সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিরা।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদের হরতাল-অবরোধ মোকাবিলা, পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ, আগামী শনিবার আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশ সফল করার বিষয়ে আলোচনা হবে। এর বাইরে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে করণীয় সম্পর্কে দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতার আন্দোলন প্রায়ই নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেখা যায়। কিন্তু এবারের মতো এত জোরালো আন্দোলন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া সরকার ও পোশাকমালিকদের পক্ষ থেকে আশ্বাসের পরও আন্দোলন জোরদার করার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত আগামী নির্বাচনের আগপর্যন্ত হরতাল, অবরোধ, ঘেরাওসহ নানা ‘আক্রমণাত্মক’, ‘ধ্বংসাত্মক’ কর্মসূচি দিতে থাকবে। তাদের আন্দোলনের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলন মিলে গেলে তাতে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই তফসিল ঘোষণার আগেই বিষয়টির একটা সুরাহা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও বলছে, বরাবরই পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কারখানার মালিকদের সক্ষমতা বিবেচনায় নেয়। তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এবার শ্রমিকেরা যে পরিমাণ ন্যূনতম বেতন চাইছেন, তা মালিকেরা মানতে প্রস্তুত নন।

আবার শ্রমিকদের দাবিও উপেক্ষা করা কঠিন। কারণ, নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সব পক্ষের মন রক্ষা করে একটা সমাধানে আসা সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তবে সরকার শিগগিরই একটা সমাধানের চেষ্টা করছে। কারণ, আওয়ামী লীগের সামনে যথাসময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তা যতটা সম্ভব নির্বিঘ্ন করার বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকশ্রমিকদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। তবে এই আন্দোলনের পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সুযোগ নিতে চাইছে, এ ধরনের তথ্য সরকারের কাছে আছে। ফলে এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও সরকার সতর্ক রয়েছে।