পদযাত্রায় বাধা, হামলা

পদযাত্রা কর্মসূচি শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। এ সময় দলটির বরগুনার পাথরঘাটা পৌর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুম বিল্লাহকে ধরে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা কিল–ঘুষি মারেন। গতকাল বেলা ১১টায় উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে
 ছবি: আমিন সোহেল

ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে সংঘাতের যে আশঙ্কা ছিল, বাস্তবেও সেটি দেখা গেছে। দেশের অন্তত ১৫টি জেলায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

গতকাল শনিবার বিএনপি পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছে। আওয়ামী লীগ করেছে শান্তি সমাবেশ। এর মধ্যে নাটোরে বিএনপির পদযাত্রা মঞ্চ দখল করে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ করার মতো ঘটনাও দেখা গেছে।

এ ছাড়া সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ও দোকানে ভাঙচুর করা হয়। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের সময় পুলিশ শটগান ও রাইফেল থেকে গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। লালমনিরহাটে ইউনিয়ন বিএনপির একটি কার্যালয় এবং ২০–২৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। আর কয়েকটি জায়গায় পুলিশের বাধায় বিএনপির কর্মসূচি পণ্ড হয়ে গেছে।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে তাঁদের কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে নেতা-কর্মীদের আহত করেছে। সংঘর্ষ এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত বা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।

তবে বিভিন্ন জেলায় সংঘাতের ঘটনায় বিএনপির ওপর দায় চাপিয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটি অভিযোগ করেছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বিএনপি সন্ত্রাস, নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছে। গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে।

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। একই সময়ে সারা দেশে শান্তি সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচিতে বিভিন্ন জায়গায় হামলার দায় সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগ এবং সরকারের। কারণ, সংঘাতের জন্যই তারা একই দিনে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে।

হামলা-সংঘর্ষ-ভাঙচুর

আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হামলায় নওগাঁ সদরে বিএনপির ৫ জন, গাজীপুরের শ্রীপুরে ৯, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে ২৭, গৌরনদীতে ১০, ভোলার ৫ উপজেলায় ৫০, সিরাজগঞ্জ সদরে ১০, বরগুনার পাথরঘাটায় ৭, নাটোর সদর, সিংড়া ও নলডাঙ্গায় ২০, নেত্রকোনা সদরে ৭, কুষ্টিয়ায় ১, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ১০, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ১২, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ৫, বগুড়ার নন্দীগ্রামে ২, কক্সবাজারের টেকনাফে ৭ এবং লালমনিরহাট সদরে ২০ জনসহ ২১৭ নেতা-কর্মী আহত হন।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। বিএনপির অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় পুলিশ বিনা উসকানিতে শটগান ও রাইফেল থেকে গুলি চালিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করার অনুরোধ জানালে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর চড়াও হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েকটি রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।

সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ও দোকানে ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচি বিঘ্ন ঘটাতে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এদিকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নে গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ করেছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। এ সময় লালমনিরহাটে ইউনিয়ন বিএনপির একটি কার্যালয় এবং ২০ থেকে ২৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। একই সময় বিএনপির হামলায় আওয়ামী লীগের ৯ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরওয়ার আলম বলেন, মহেন্দ্রনগরের বুড়িরবাজারে বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলায় মহেন্দ্রনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্য তাহমিদুল ইসলামসহ দলের ৯ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। তবে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা দিবালোকের মতো সত্যি।

এ ছাড়া নীলফামারী সদর উপজেলার কচুকাটা ইউনিয়নে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

কর্মসূচিতে বাধা, পণ্ড

নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নে মিছিল করার ফাঁকে বিএনপির পদযাত্রা মঞ্চ দখল করে শান্তি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। ছাতনী ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুজ্জামান বলেন, গতকাল ছাতনী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সামনে শান্তি সমাবেশ শুরু করে আওয়ামী লীগ। তাই সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বটতলা মোড়ে বিএনপি কর্মসূচি দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্ধারিত স্থান ছেড়ে এসে তাঁদের মঞ্চ দখল করে সমাবেশ করেন। বিশৃঙ্খলা এড়াতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কাউকে বাধা দেননি।

অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল সরকার বলেন, ‘বিএনপি কর্মসূচি পালন করবে না বলে গতকাল রাতে কথা দিয়েছিল। তাই আমরা বটতলায় কর্মসূচি দিইনি। কিন্তু তারা যখন জেলার নেতাদের এনে কর্মসূচি শুরু করে, তখন আমরা বটতলায় না এসে পারিনি।’

এদিকে বগুড়ার আদমদীঘিতে পুলিশের বাধায় পদযাত্রা কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। উপজেলা সদরের কর্মসূচি পণ্ড হওয়ায় উপজেলার অন্য কোনো ইউনিয়নে কর্মসূচি করতে পারেনি দলটি। ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলেন, পুলিশ বাধা দেওয়ায় কর্মসূচি পালন করা যায়নি। তবে আদমদীঘি থানার ওসি রেজাউল করিম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বগুড়া-নওগাঁ সড়কে যানজট এড়াতে পদযাত্রা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু।’

নরসিংদীর পলাশে পদযাত্রা কর্মসূচিতে কয়েক দফা বাধা দেওয়ার পর তাদের ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশ কর্মসূচি পণ্ড করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নের চরনগরদী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কর্মসূচিতে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মঈন খান।

পুলিশের বাধায় পদযাত্রা কর্মসূচি পণ্ড হওয়ার পর শতাধিক নেতা-কর্মীকে নিয়ে চরনগরদী গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে যান আবদুল মঈন খান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে গেছে। আমরা হিংসাত্মক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না বলেই পুলিশের উসকানি ও বাধার মুখেও কোনো দ্বন্দ্বে জড়াইনি।’

পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘আমরা তাঁদের বলেছি, পদযাত্রা করবেন আপত্তি নাই, জেলা প্রশাসকের অনুমতিপত্র দেখান। তাঁরা আমাদের কোনো অনুমতিপত্র দেখাতে পারেননি। তাই নিয়মানুযায়ী বাধা দেওয়া হয়েছে।’

ময়মনসিংহের বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মসূচি পালনে পুলিশের বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়া বাজারে বিএনপির পদযাত্রার প্রস্তুতির সময় হামলা ঘটনা ঘটে।

ময়মনসিংহ উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আজিজুল হক আজিজুল হক বলেন, গতকাল বিকেলে গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া বাজারে বিএনপির পদযাত্রার প্রস্তুতির সময় আওয়ামী লীগের কর্মীরা সেখানে হামলা করেন।

রংপুরের বদরগঞ্জ পৌর এলাকার ধানহাটি মোড়ে বিএনপির পদযাত্রায় বাধা দেয় পুলিশ। পরে সেখানেই সমাবেশ করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বরগুনার বেতাগীতে বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা ও হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বেতাগী থানার ওসি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপির পদযাত্রায় বাধা দেয়নি পুলিশ। যেখানে বিএনপি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছে, সেখানে হয়তো পুলিশ বাধা দিয়েছে।

এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা ও বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দুদিনে আটক ৬৪

বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে বিএনপির ৬৪ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে যশোরে ১২ জন, মেহেরপুরে ১৩, লক্ষ্মীপুরে ১ ও সিরাজগঞ্জে ৩৮ জনকে আটক করা হয়।

যশোর সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে বিএনপির ১২ জন নেতা-কর্মীকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। মেহেরপুরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিএনপির ১৩ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

মেহেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ বলেন, সরকার বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আটক করে আন্দোলন দমাতে অহেতুক মিথ্যা মামলা সাজিয়ে গ্রেপ্তার করছে। এসব করে সরকার কতটা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ দিচ্ছে। মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিরুল ইসলাম বলেন, নাশকতার মামলায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরও ২৫ জনকে আটকের চেষ্টা চলছে।

এদিকে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জেলা যুবদলের সভাপতিসহ দলটির ৩৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম ও অপস্) সামিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে এক বা একাধিক মামলা আছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]