টানা ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলেন আজমত উল্লা খান। এরপর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। তাতে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে। এর ঠিক ১০ বছর পর এবার তৃতীয় মেয়র নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আজমত উল্লা। আগের চেয়ে ব্যবধান কমলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে হেরেছেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তাতে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হন টেবিলঘড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। তিনি ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হারান নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে। জায়েদা খাতুন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা।
আজমত উল্লার এই পরাজয় নিয়ে গাজীপুরের রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। তাঁর পরাজয়ের পেছনে কোনো একক নয়, একাধিক কারণ কাজ করেছে বলে রাজনৈতিক দলের নেতা, রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তি ও সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন। তাঁদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য বার্তা। একজন ছায়া প্রার্থীর কাছে এমন পরাজয় থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালে। তাতে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
বর্ষীয়ান নেতা হিসেবে গাজীপুরে আজমত উল্লা খানের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। দলীয় কর্মকাণ্ডে থাকেন তিনি। কিন্তু দলের বাইরে সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁকে সহজে পাওয়া যায় না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া টঙ্গী অঞ্চল ছাড়া বাকি এলাকাগুলোতে তাঁর বিচরণ কম। অনেক এলাকায় তাঁর নাম এলাকাবাসী জানলেও নির্বাচনের আগে তাঁকে চোখেও দেখেননি, এমন ভোটারের সংখ্যাও অনেক।
মহানগরীর শহর অঞ্চল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরে ভূরুলিয়া এলাকা। ওই এলাকার বাসিন্দা এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী হোসেন আলী। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর এলাকায় রাস্তাঘাট করেছেন। আজমত উল্লার নামই শুধু শুনেছি। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ জাহাঙ্গীরের জন্যই তাঁর মায়ের পক্ষে কাজ করেছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও কাজ করেছে। স্থানীয় ভোটার ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তা জায়েদা খাতুনের জন্য বাড়তি সুবিধা করে দেয়।
আজমত উল্লার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজমত উল্লার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, সেটি এখনই আমরা বলব না। আমরা বিষয়টি নিয়ে আমাদের সব নেতার সঙ্গে বৈঠক করব। কী কী কারণে দলের প্রার্থী হেরে গেলেন, সেগুলো খুঁজে বের করা হবে।’
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েই মূলত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর তাঁর মা জায়েদা খাতুনকে প্রার্থী করেন। অবশ্য তিনি নিজেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঋণখেলাপির জামিনদার হওয়ায় তাঁর প্রার্থিতা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কৃত হন তিনি। কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে কার্যত আজমত উল্লার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাহাঙ্গীর। মায়ের পক্ষে দিনরাত প্রচার চালিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আজমত উল্লাও নির্বাচনী প্রচারে যা বলেছেন, এর প্রায় সবই ছিল জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক।
জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান থাকার সময় থেকেই তরুণদের সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তখন থেকেই তাঁর একটি বড় কর্মী বাহিনী গড়ে ওঠে। মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাহাঙ্গীর। তিনি তাঁর কর্মী বাহিনীকে বিভিন্ন কমিটিতে সম্পৃক্ত করেন। সিটি নির্বাচনের সময় এই নেতা-কর্মীরাই আজমত উল্লার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পান।
গাজীপুরে এমন অভিযোগও আলোচনায় রয়েছে যে দলীয় ‘চাপে’ জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ আজমত উল্লার পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠেও নামেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করেন। গলায় নৌকা বা আজমত উল্লার ব্যাজ ধারণ করে গোপনে জাহাঙ্গীর আলমের জন্য কাজ করেন।
কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত এক কাউন্সিলর নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজমত উল্লার সঙ্গে থাকতে হয়েছে বাধ্য হয়ে, কিন্তু আমরা তো জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থক। আমরা তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। সামনাসামনি হয়তো কাজ করতে পারিনি, কিন্তু গোপনে তাঁর জন্য কাজ করেছি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় জাহাঙ্গীর আলমকে। তিন বছর দায়িত্বে থাকার সময় এলাকায় বেশ কিছু সড়কের উন্নয়ন করেন জাহাঙ্গীর। প্রশস্ত এসব সড়কে অনেক এলাকার চিত্র বদলে গেছে। এসব সড়কের উপকার পাচ্ছেন নগরীর লাখো বাসিন্দা। তাঁরা মনে করেন, জাহাঙ্গীর আলম পুরো মেয়াদ দায়িত্বে থাকলে নগরীর আরও উন্নতি করতে পারতেন।
জাহাঙ্গীরের জন্য মানুষের এই সহানুভূতি কাজ করেছে জায়েদা খাতুনের নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রেও। গতকালের ভোটে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ভোটার কেন্দ্রে গেছেন। তাঁদের বড় অংশের ভোট জায়েদা খাতুন পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে দলের পরীক্ষিত ও বর্ষীয়ান নেতা আজমত উল্লার পরাজয় মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। দলের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, জায়েদা খাতুন মোটামুটি ভোট পেলেও কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারবেন না। সেখানে মোটামুটি ভালো ব্যবধানে জিতে যাওয়ায় তাঁরা বিস্মিত। তাঁদের মতে, জায়েদা খাতুনকে প্রার্থী হিসেবে হালকাভাবে নিয়েছিলেন।
যদিও জায়েদা খাতুনের প্রচারপর্বের পুরোটাই ছিল জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক। প্রচারের সময় ছাদখোলা গাড়ির সামনের আসনে বসে থাকতেন জায়েদা খাতুন, আর ছেলে জাহাঙ্গীর গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তেন। প্রচারের মায়ের হয়ে বক্তব্যও দিতেন তিনি। ফলে ভোটে আজমত উল্লার হেরে যাওয়াকে জাহাঙ্গীরের জয় বলেই উল্লেখ করছেন তাঁর অনুসারীরা।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এমন আলোচনাও রয়েছে, আওয়ামী লীগবিরোধী বেশির ভাগ ভোট পেয়েছেন জায়েদা খাতুন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলামের (হাতি প্রতীক) পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মাত্র ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন। ভোটের এই হিসাবের ভিত্তিতে আলোচনায় এসেছে যে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যাঁরা কেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের ভোট জায়েদা খাতুনের পক্ষে গেছে।
সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন। গাজীপুরের শ্রমিকনেতা ও হেফাজত নেতাদের সঙ্গে সব সময় সখ্য রেখেছেন জাহাঙ্গীর। জায়েদা খাতুনের নির্বাচনের জয়ের পেছনে তাঁদের ভোটও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে আবেগের কাছে যোগ্যতার পরাজয় হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিলের পর সাধারণ ভোটারদের মনে সেটার প্রভাব পড়ে। আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকখ্যাত এলাকাতে স্থানীয় নেতৃত্ব সামর্থ্য প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিযোগিতা কীভাবে প্রতিহিংসায় পরিণত হতে পারে, তার বড় প্রমাণ স্থানীয় আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে দেখিয়েছে।