প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে শীর্ষ বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত ও দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত তিস্তা চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি নেই। এবার সই হয়েছে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে একটি সমঝোতা। ভারতের পক্ষ থেকে বিনা মাশুলে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রানজিট/ট্রানশিপমেন্টের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মেঘালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গে সংযুক্তির জন্য বাংলাদেশে একটি মহাসড়ক তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। আর ভারত থেকে ডিজেল এবং চাল, গমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিশ্চিত সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এসব সমঝোতা ও প্রস্তাবের বিষয়ে কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ঘিরে যে প্রত্যাশা ছিল, সেখানে প্রাপ্তি যেমন আছে, তেমনি হতাশাও আছে। কেউ কেউ বলছেন, এই সফর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ। তবে এতে বড় কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। আবার কারও কারও মতে, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হলে ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
তিস্তা চুক্তি ১১ বছর ধরেই আটকে আছে। এবার চুক্তিটি সই হবে, তেমন প্রত্যাশা ছিল না। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গত দুবার শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনায় বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও সেটি এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ভারতের সেই আশ্বাস এবার অনুপস্থিত শীর্ষ বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে।
দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের আলোচনায় সংযুক্তির নানা বিষয়ে অগ্রগতি এবং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যখন সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) সইয়ের জন্য আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, তখন সংযুক্তির প্রকল্প এবং আগের সিদ্ধান্তগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে এর সুফল পাওয়া যাবে না।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে যে যাতায়াত হয়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর সেই ধারাবাহিকতার অংশ। শীর্ষ বৈঠক শেষে প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থে কিছু বিষয় বলা হয়েছে। আবার এই বিবৃতিতে হতাশার দিকও আছে। প্রত্যাশা থাকবে, হতাশার দিকগুলো দূর করতে দুই পক্ষ যৌথ প্রয়াস চালাবে।
এবারের যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় সংযুক্তির পাশাপাশি আঞ্চলিক সংযুক্তি, জ্বালানি ও খাদ্যনিরাপত্তায় জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন, আন্তসঞ্চালন লাইন চালুর মাধ্যমে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর বিষয়ে ভারতের নজর রয়েছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং দেশটির প্রধান জি-২০-এর সমন্বয়কারী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে অনেক বেশি অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানি ও খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে। বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা কথা বলেছেন। যেকোনো অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক দেশ যাতে অন্য দেশের প্রতি জোরালো সহযোগিতা অব্যাহত রাখে, সে বিষয়ে এবারের সফরে গুরুত্ব পেয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলের সুফল নিশ্চিত করতে হলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক যাতে শক্তিশালী থাকে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন দিল্লিভিত্তিক নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ পন্থ। তিনি গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতির নজর নিবদ্ধ হয়েছে। তাই ভারতের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নত বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই।
হর্ষ পন্থের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে যথেষ্ট স্থিতিশীল বলেই বিবেচিত। দুই দেশের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু দুই দেশ একে অন্যের মত তুলে ধরতে পারে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভিন্নমতের বিষয়টি বেশ খোলামেলাভাবেই প্রকাশ্যে বলেছেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা কত জরুরি, সেটা বোঝাতে গিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্ট-এর পরামর্শক সম্পাদক জ্যোতি মালহোত্রা তাঁর নিবন্ধে মেঘালয় থেকে বাংলাদেশ হয়ে ত্রিপুরায় জ্বালানি পরিবহনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মেঘালয় থেকে জ্বালানিবাহী ১০টি ট্যাংকার ২৫ আগস্ট দুপুরে ডাউকি স্থলবন্দর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ওই দিন রাত সাড়ে ১০টায় জ্বালানিবাহী ট্যাংকারগুলো ত্রিপুরায় পৌঁছে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এমন এক সংকটের সময়ে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি অভাবনীয়। এতে সময় ও অর্থ—দুটোরই সাশ্রয় হয়েছে।