জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা পরিষদেও এখন জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশ ব্যবসায়ী ও কোটিপতি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে যাঁরা চেয়ারম্যান হয়েছেন, তাঁদের ৭৬ শতাংশই ব্যবসায়ী। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে কোটিপতি রয়েছেন ৪৭ জন।
নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা ভোটের আগে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁদের পেশা, আয়, অস্থাবর সম্পদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলা ও জমির তথ্য বিশ্লেষণ করেছে প্রথম আলো। এতে দেখা গেছে, নির্বাচিত ১৩৮ জনের মধ্যে ১০৫ জনই ব্যবসায়ী। কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ১২ জন। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থাকার কথা বলেছেন ৭ জন, আইনজীবী ৫ জন। পেশা রাজনীতি—এমনটি উল্লেখ করেছেন ২ জন। অন্যান্য পেশা থেকে এসেছেন ৭ জন।
যে দুজন পেশা হিসেবে রাজনীতিবিদ উল্লেখ করেছেন, তাঁরা হলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের শাহিন আহমেদ ও খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির মো. জয়নাল আবেদীন। এর মধ্যে শাহিন আহমেদ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি টানা চতুর্থ দফায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে জয়নাল আবেদীন খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৮ মে দেশের ১৩৯টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ফলাফল স্থগিত রয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনের চার মাস আগে এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে যে সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা অন্তত ১৯৯ জন, যা সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। অবশ্য এই নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮২ জন। স্বাধীনতার পর সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। এখন স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ধাপেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জাতীয় সংসদের পর উপজেলা পরিষদেও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রায় সব স্তরে তাঁদের ‘নিয়ন্ত্রণ’ আরও জোরদার করবে। ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতিতে যে বিনিয়োগ করছেন, তা করছেন মূলত নিজেদের সম্পদ আরও বাড়ানোর জন্য। ব্যসায়ীদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদদেরই কোণঠাসা করে ফেলছে। রাজনীতিতে টাকা যে বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে অধিক সম্পদশালীদের জয়লাভের মাধ্যমে। রাজনীতিতে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো সংস্কার আর্থিক খাতে এখন আর করা যাচ্ছে না।
এবার উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে যাঁরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১০ জনের স্বজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। এর মধ্যে মাদারীপুর–২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শাজাহান খান, নোয়াখালী–৪ আসনের একরামুল করিম চৌধুরী, নোয়াখালী–৬ আসনের মোহাম্মদ আলী ও বগুড়া–১ আসনের সাহাদারা মান্নানের ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার জামাতা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের মধ্যে শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই, সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই, মাহবুবুল আলম হানিফের চাচাতো ভাই, আলী আজগারের ভাই এবং ঠাকুরগাঁও–২ আসনের সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলামের চাচা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
সংসদ সদস্যদের স্বজনেরা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আসায় স্থানীয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের ‘শাসন’ কায়েম হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্যরা উন্নয়ন কার্যক্রমসহ সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। তাই স্থানীয়ভাবে দলীয় পদ, স্থানীয় সরকারের পদ নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে রাখতে চান। এর মধ্য দিয়ে পরিবারতন্ত্রের স্থানীয়করণ হয়েছে। তিনি বলেন, দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা উপজেলা চেয়ারম্যান হলে, তাঁরা পদের দাপটে নিজেদের সম্পদ ও ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলেন।
প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য নিয়ে ‘হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি’ নামে একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এর ভিত্তিতে টিআইবি বলেছিল, চেয়ারম্যান পদে (প্রথম ধাপে) প্রার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী। ২০১৪ সালের চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় এবার ব্যবসায়ী প্রার্থীর সংখ্যা ৮ শতাংশ বেশি।
প্রথম ধাপে ভোট হওয়া ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে (একটির ফল স্থগিত) ১১৮টিতেই চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের নেতারা জয়ী হয়েছেন। সাতটিতে জয় পেয়েছেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা, দুটিতে জাতীয় পার্টি (জাপা), দুটিতে জনসংহতি সমিতি ও বাকিগুলোতে নির্দলীয় প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জন করছে বিএনপি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক দেয়নি। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হওয়া চেয়ারম্যানদের আয় ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪৭ জন চেয়ারম্যানই আয় ও সম্পদ মিলিয়ে কোটি টাকার মালিক।
ভোটের আগে টিআইবি প্রার্থীদের অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে বলেছিল, প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি ছিলেন ৯৪ জন। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কোটিপতি প্রার্থীরাই বেশি জয়লাভ করেছেন।
সবচেয়ে বেশি ২৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান ভূঁইয়ার। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী।
২০ কোটি টাকার বেশি অস্থাবর সম্পদের মালিক রংপুরের কাউনিয়ার চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান। আনোয়ারুল ইসলাম মায়া বিড়ি কারখানার অংশীদার। পণ্য আমদানির ব্যবসা রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া মায়া অ্যাগ্রো প্রসেসিং, মায়া পেপার মিল ও মহুবুর রহমান কোল্ড স্টোরেজের পরিচালক তিনি।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন আতাহার ইশরাক ওরফে শাবাব চৌধুরী। তিনি নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে। পেশায় ব্যবসায়ী শাবাব চৌধুরীর অস্থাবর সম্পদ রয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকার।
চেয়ারম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার্ষিক আয় দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনের। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, তাঁর বার্ষিক আয় ৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আলমগীর হোসেন বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেডের পরিচালক।
সিরাজগঞ্জ সদরের উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনের আয় বছরে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। তিনি শান্তা ডেইরি ফার্মের মালিক। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় যুক্ততা রয়েছে তাঁর।
কুষ্টিয়া সদরের চেয়ারম্যান হয়েছেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। পেশায় ঠিকাদার আতাউরের বার্ষিক আয় ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তিনি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই।
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হওয়া চেয়ারম্যানদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেশি। স্নাতক পাস চেয়ারম্যান ৪৬ জন, স্নাতকোত্তর ৩০ জন। উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করা চেয়ারম্যান ৪৯ জন। আর স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ৯ জন চেয়ারম্যান হয়েছেন।
নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৬৭ জনের নামে কোনো না কোনো সময় মামলা ছিল। বিএনপির যে ৭ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১২০টি।
নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে অন্তত দুজনের কৃষি ও অকৃষিজমির পরিমাণ ৩৩ একরের বেশি। অর্থাৎ জমির মালিকানার দিক দিয়ে তাঁরা আইনি সীমা অতিক্রম করেছেন। ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর জমির মালিক হতে পারেন।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলামের নামে কৃষিজমি রয়েছে ৫১ দশমিক ৬৭ একর। এর অর্জনকালীন মূল্য ১ কোটি ৭৬ লাখ। এ ছাড়া ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা অর্জনকালীন মূল্যের অকৃষিজমি রয়েছে তাঁর।
সীতাকুণ্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আরিফুল আলম চৌধুরীর রয়েছে ৪০ দশমিক ১ একর জমি। এর বাইরে পুরোনো জাহাজের মালামাল কেনাবেচার ব্যবসা রয়েছে তাঁর।
ব্যবসার রাজনীতিকরণ
উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশ এখন ব্যবসায়ী, এ বিষয়টি কোনো সুখকর পরিণতি বয়ে আনবে না বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রাজনীতি এখন ব্যবসা হয়ে গেছে। রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ ও ব্যবসার রাজনীতিকরণ হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়েও কর্তৃত্ববাদ ও সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে।