বরিশাল মহানগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করায় বিস্মিত নেতারা

বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। আড়াই বছর আগে মহানগরের দীর্ঘদিন সভাপতির নেতৃত্বে থাকা মজিবর রহমান সরোয়ারকে বাদ দিয়ে তাঁর বিরোধীদের দিয়ে এই আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ফলে শুরু থেকেই এই কমিটি নিয়ে বিতর্ক ও নানা রকমের দ্বন্দ্ব চলছিল।

দ্বন্দ্বের জেরে দলটির কর্মসূচিতে প্রায়ই নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হতো। টাকার বিনিময়ে নেতা বানানোর মতো অভিযোগও উঠেছিল। বিশেষ করে মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারীদের এই কমিটিতে না রাখায় শুরু থেকেই তাঁদের বিরোধীতার মুখে পড়েছিলেন আহ্বায়ক কমিটির নেতারা। পরে আহ্বায়ক কমিটির নেতারাও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়ান। ফলে বরিশালে বিএনপির রাজনীতি লেজেগোবরে অবস্থা হয়। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতেও একই অবস্থা চলছিল।

বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার দীর্ঘদিন বরিশাল মহানগরের সভাপতি পদে থাকায় দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাঁর এখনো শক্ত অবস্থান রয়েছে। তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ও সদর আসনের চারবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদের হুইপের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর তাঁকে (সরোয়ার) মহানগরের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় পর গঠিত কমিটিতে মনিরুজ্জামান খান ওরফে ফারুককে আহ্বায়ক, আলী হায়দার ওরফে বাবুলকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কেউ স্থান পাননি। ৪১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদনের আগে তা নিয়ে আপত্তি তোলেন বিলুপ্ত কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তাঁরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাঁদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি।

মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের মধ্যেই ২০২২ সালের ১১ মার্চ সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ৩০টি কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা সবাই মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী ছিলেন। ফলে মহানগরের রাজনীতি মজিবর রহমান সরোয়ার ও তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তবে বঞ্চিত এই নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান করেছেন, যা মহানগর আহ্বায়ক কমিটির মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল।

এমন অবস্থার মধ্যেই গতকাল গভীর রাতে বরিশাল মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করা হলো। আজ শুক্রবার সকালে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। গুঞ্জন ওঠে, তাহলে কী বরিশাল মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে আবারও মজিবর রহমান সরোয়ারের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে?

বিলুপ্ত হওয়া আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কমিটি বিলুপ্ত করা হবে, তা আগে থেকে কোনো নেতাই জানতেন না।

বিলুপ্ত হওয়া কমিটির সদস্য ও দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এমনকি নতুন করে কবে নাগাদ কমিটি করা হবে, সে ব্যাপারেও আমরা সবাই অন্ধকারে।’

এদিকে আকস্মিক কমিটি ভেঙে দেওয়ার খবরে অনেকটা বিস্মিত হয়েছেন নেতারা। অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পাচ্ছেন না। কবে নাগাদ আবার কমিটি করা হবে এবং আবার আহ্বায়ক কমিটি হবে, না পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে—সে ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা পাচ্ছেন না কেউ।

বিলুপ্ত কমিটির সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি বিলুপ্ত করার বিষয়টি আমরা আগে থেকে জানতাম না। তবে তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি আড়াই বছরের বেশি সময় পার করেছে। তাই বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই মনে হচ্ছে।’

দলীয় সূত্র জানায়, ভেঙে দেওয়া কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ও সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবিরের সঙ্গে যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়া উদ্দিন সিকদারের সঙ্গে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। জিয়াউদ্দিন সিকদারের পক্ষে ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান। ফলে এ নিয়ে বিলকিস আক্তার জাহানের সঙ্গে মনিরুজ্জামান খান ও মীর জাহিদুল কবিরের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে এই দুই নেতার সম্পর্কের উন্নতি হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, হঠাৎ কমিটি বিলুপ্ত করার নেপথ্যে এই দ্বন্দ্বের জের রয়েছে। বিলকিস আক্তার জাহান ও আকন কুদ্দুসুর রহমান মহানগরে তাঁদের কর্তৃত্ব পোক্ত করতে জিয়াউদ্দিন সিকদারসহ তাঁদের অনুসারীদের নেতৃত্বে আনতে চান।

তবে বিলকিস আক্তার জাহান এসব অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, এটা দল পুনর্গঠনপ্রক্রিয়ার অংশ। এ ছাড়া একসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখন নতুন করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিদ্ধান্ত নেবেন।

সমন্বয় চান সরোয়ার

কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী নেতারা অনেকটা সক্রিয় হয়েছেন। তাঁরা এত দিন পদবঞ্চিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদেরকে দলীয় কর্মকাণ্ডে ডাকা হতো না, এমনকি তাঁরাও আসতেন না। কিন্তু গতকাল রাতে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর তাঁরা অনেকটা উজ্জীবিত। তাঁরা চাইছেন, বরিশালে বিএনপির সেই পুরোনো শক্তিশালী সাংগঠনিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে একটি কমিটি গঠন করা হোক।

মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন বলেন, ‘দুর্দিনে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বরিশাল মহানগরকে বিএনপির দুর্গে পরিণত করেছি। কিন্তু আড়াই বছর ধরে আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এতে বরিশালে বিএনপির রাজনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। আমরা চাই এই অবস্থা বুঝে এখানে একটি শক্তিশালী কমিটি দিক কেন্দ্র।’

দলের এই অচলাবস্থা নিরসনে বরিশালে পূর্ণাঙ্গ কমিটির পক্ষে অনেক নেতা-কমী। সে ক্ষেত্রে সমন্বয়ের বিকল্প দেখছেন না তাঁরা। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার দাবিতে আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা মহানগর বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

জানতে চাইলে মজিবর রহমান সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি বিলুপ্ত করাটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই অংশ বলে মনে করি। এখন পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হতে পারে, আবার আহ্বায়ক কমিটিও হতে পারে। তবে যা–ই হোক, সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করেই যা করার করতে হবে। কারণ, আগে আহ্বায়ক কমিটি নেতৃত্ব দেওয়ার সময় আন্দোলন-সংগ্রাম অনেক ক্ষতি হয়েছে। লিডারশিপ তৈরি হয়নি।

বিলকিস আক্তার জাহানের প্রসঙ্গ টেনে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘তাঁরা একটি কোরাম তৈরি করেছেন, এটা আমি শুনেছি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে এ নিয়ে দুই পক্ষে মারামারিও হয়েছে। এটা দলের জন্য খুবই ক্ষতিকর।’