রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আজ রোববার বিকেলে মতবিনিময় সভা করেন জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা
রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আজ রোববার বিকেলে মতবিনিময় সভা করেন জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা

বিক্ষুব্ধ নেতা–কর্মীদের সভায় জি এম কাদেরসহ জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ

সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর জাতীয় পার্টির (জাপা) পরাজিত কয়েকজন প্রার্থীর নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ নেতা–কর্মীদের একটা অংশ আজ ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভা করেছে। এই সভায় দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ভোটে প্রার্থীদের সহযোগিতা না করাসহ নানা অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে এই মতবিনিময় সভা করেন জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ নেতা–কর্মীরা। মতবিনিময় সভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দলটির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম, সাইফুদ্দিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন নেতা বক্তব্য দেন।  

জাপার এই নেতাদের নেতৃত্বে জাপার বিক্ষুব্ধ নেতা–কর্মীরা নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি ঢাকার বনানীতে দলের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেছেন। সেই বিক্ষোভ থেকে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হকের (চুন্নু) পদত্যাগও দাবি করা হয়েছিল। এর জেরে গত শুক্রবার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আজ মতবিনিময় সভায় বিক্ষুব্ধ নেতারা ভোটে তাঁদের দলের বিপর্যয়ের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে জাপার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেন, নির্বাচনে জাতীয় পার্টির যাওয়া উচিত হয়নি। তাঁরা বলছেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করার কারণে মানুষ জাতীয় পার্টিকে ভোট দেননি। দলের মহাসচিব পোস্টারে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত লিখে জাতীয় পার্টির বড় ক্ষতি করেছেন। নির্বাচনে না গেলে দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের দেশের জনগণের কাছে হিরো হতেন বলে মনে করেন তাঁরা।

মতবিনিময় সভায় নির্বাচনে প্রচারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফজলে এলাহী বলেন, ‘ভোট চাওয়ার সময় মানুষ বলেছে ২৬ মাথা বিক্রি করেছেন, কীভাবে ভোট চাইতে আসেন। আমরা তো চাইনি ২৬টি মাথা বিক্রি করে দেন।’ দলের চেয়ারম্যানের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এমন সময় সিদ্ধান্ত দেন, ডানেও যেতে পারি না, বায়েও যেতে পারি না। আমরা বারবার জাতির সঙ্গে বেইমানি করে মোনাফেক হয়ে যাচ্ছি।’

নির্বাচনের সময় দলের মহাসচিবকে অন্তত ১০০ বার কল দিয়েছেন জানিয়ে জাতীয় পার্টির এই প্রার্থী বলেন, তিনি ফোন ধরেননি। এ সময় দর্শকসারিতে বলা লোকজন ‘ওরে বাটপার, ওরে বাটপার’ বলে মহাসচিবকে ব্যঙ্গ করেন।

মতবিনিময় সভায় কিশোরগঞ্জ–৬ আসনে পরাজিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল কাদের বলেন, নির্বাচনের আগে একই মিলনায়তনে বিশ্বাস করে দলের চেয়ারম্যানকে আমরা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের এবারও বলির পাঁঠা বানানো হলো। এই প্রার্থীর নামে ১০ লাখ টাকা রিসিভ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি তাঁর টাকা কোথায় তা দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে জানতে চান।

সিরাজগঞ্জ–১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সময় মহাসচিবকে কল করে পাইনি। টাকা দিতে না পারেন মানসিক সমর্থনও দিতে পারতেন। আর সিরাজগঞ্জ–৬ আসনের প্রার্থী মোক্তার হোসেন বলেন, ‘আমাদের নামে বরাদ্দ করা টাকা কোথায় গেল তা জানতে চাই।’

সিলেট-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইয়াহিয়া চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জি এম কাদেরের মুখ থেকে স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা শুনে এলেও এবারের নির্বাচনে নিজের স্ত্রী শেরীফা কাদেরের আসন নিশ্চিত হওয়ার পর সমঝোতা করে অন্য সব ভুলে গেছেন।’  

মতবিনিময় সভায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়েছেন দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব।
দলে আঘাতপ্রাপ্ত ও বহিষ্কৃত লোকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে উল্লেখ করেন শফিকুল ইসলাম। তিনি জাপার শীর্ষ নেতাদের ইঙ্গিত করে বলেন, ঘুঘু দেখেছেন ঘুঘুর ফাঁদ দেখেননি। ঘুঘুর ফাঁদ দেখতে চাইলে দেখিয়ে দেব। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে মহাসচিব বলেছিলেন চমক দেখাবেন। ২৬৫ প্রার্থীকে পানিতে ফেলে দেওয়াই কি চমক ছিল? ২৬ আসনে সমঝোতা করে ১১ আসনে জয়ী হওয়া কি চমক ছিল? আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার কারণে মানুষ জাতীয় পার্টিকে ভোট দেয়নি। এর দায় দলের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকের।

কাজী ফিরোজ রশীদকে দল থেকে অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার করা না হলে অব্যাহতি পাওয়া ও বহিষ্কৃত লোকেরা এক হয়ে যাবে বলেও জানান শফিকুল ইসলাম।
দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ–৩ আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থী লিয়াকত হোসেন বলেন, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা একত্র হননি।

নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পরাজিত প্রার্থীদের সঙ্গে দলটির নেতাদের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতাকর্মীদের একাংশ। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে

কানকথা শুনে দলকে নষ্ট না করার আহ্বান জানিয়ে জি এম কাদেরের উদ্দেশে লিয়াকত হোসেন বলেন, চাটুকারেরা নিজেদের অবস্থানের জন্য আপনাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়।  

ঢাকা–৭ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জি এম কাদের গত পাঁচ বছর দলকে আকাশে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে না গেলে তিনি হিরো হতেন। হয়তো এখন কিছু পেতাম না। আগামীর বাংলাদেশ আমাদের বাংলাদেশ হতো। এটা আমি জি এম কাদেরকে বলেছি।’ নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণে দলের অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন সাইফুদ্দিন।

মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে দলের কো–চেয়ারম্যান ও ঢাকা–৪ আসনের প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে আমরা চরম হতাশ হয়েছি। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছি। মাত্র ১১ আসনে জয়ী হয়েছি। দল ভাঙার জন্য আমরা মিলিত হইনি। ব্রাকেটবন্দী জাপা করার কোনো প্রয়াস আমাদের নেই।’

দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে ৪৮ ঘণ্টার যে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে, এর সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান সৈয়দ আবু হোসেন। তিনি বলেন, আল্টিমেটাম কে দিয়েছে, তা তদন্ত করে তাঁরা বের করবেন।