শ্রদ্ধা নিবেদনে বিশিষ্টজনেরা

প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা, ২৫ এপ্রিল
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান গার্ড অব অনারে শেষবিদায় জানানো হলো প্রবীণ রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার অগ্রগণ্য ব্যক্তিরা বললেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য বিদায় নিলেও তিনি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। তাঁদের মূল্যায়নে, একজন রাজনীতিক সত্যিকার অর্থে কেমন হওয়া উচিত, তার বড় উদাহরণ পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তাঁর চলে যাওয়ায় রাজনীতিতে বড় শূন্যতার সৃষ্টি হলো।

ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য গত রোববার রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পঙ্কজ ভট্টাচার্যের কফিন রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তৈরি করা অস্থায়ী মঞ্চে

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মরদেহ মঙ্গলবার বিকেল চারটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা মঞ্চে নেওয়া হয়। এ সময় তাঁর দল ঐক্য ন্যাপের পক্ষ থেকে দলীয় পতাকায় মরদেহ মুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। তাঁকে গার্ড অব অনার দেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেদায়েতুল ইসলাম।

এরপর পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়। হুইলচেয়ারে করে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পঙ্কজ ভট্টাচার্য একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সারা জীবন জনগণের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন এবং সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তাঁকে হারিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি প্রেরণার উৎস হয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’

পঙ্কজ ভট্টাচার্য একসময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগ দিয়েছিলেন। পরে গণফোরাম থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হাছান মাহমুদ বলেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য আজীবন একজন সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। কোনো পদ-পদবির পেছনে তিনি ছোটেননি। একজন রাজনীতিক সত্যিকার অর্থে কেমন হওয়া উচিত, সেটির উদাহরণ পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তাঁর মৃত্যুতে রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন থেকে বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছুই শেখার আছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনসহ কয়েকজন নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন একসময়ের রাজনৈতিক সহকর্মীর প্রতি স্মৃতিচারণা করে বলেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হলো।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন গণফোরামের নেতারা

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ষাটের দশকে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। শ্রদ্ধা জানাতে এসে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য একজন সজ্জন মানুষ ছিলেন। সবার প্রতি যত্নবান ছিলেন। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা থেকে বর্তমান প্রজন্ম শিক্ষা নিতে পারে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে সব রাজনৈতিক ঘটনার সামনের কাতারে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ নেতা-কর্মীরা

গার্ড অনার অনার শেষে শুরু হয়েছিল পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংগঠন প্রয়াত এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী ও মফিদুল হক, সংস্কৃতিজন রামেন্দু মজুমদার ও মামুনুর রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, সহ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ, ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, রাজনীতিক মোস্তফা জামাল হায়দার, মুশতাক হোসেন, অধ্যাপক কাজী মদিনা, সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, কবি কামাল চৌধুরী, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার, সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশে ভারত দূতাবাসের পক্ষে কূটনীতিক রাজেশ অগ্নিহোত্রী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, গণফোরামের একাংশের নেতা মোস্তফা মহসীন, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকী, সাবেক সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস, নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত প্রমুখ।

এ ছাড়া শ্রদ্ধা জানাতে আসা দল ও সংগঠনের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাম গণতান্ত্রিক জোট, সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল (এমএল), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জেএসডি, ন্যাপ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ কৃষক লীগ, মণি সিংহ–ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, গারো ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, আদিবাসী যুব ফোরাম, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বিশেষ গেরিলা বাহিনী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, রণেশ মৈত্রের পরিবার, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ, মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক জোট, গণ আজাদী লীগ, আইনজীবী সংসদ, যুব মৈত্রী, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, দেশীয় চিকিৎসক সমিতি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, প্রগতি লেখক সংঘ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় উপস্থিত অনেককেই কাঁদতে দেখা যায়

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের পরিবারের পক্ষে বক্তব্য দেন প্রয়াতের শ্যালিকা মৌসুমি দাশ পুরকায়স্থ। তিনি বলেন, ‘পঙ্কজ ভট্টাচার্য নামের যে সংগ্রামী মানুষটি এই দেশের জন্য তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, আজ তাঁর এই যাওয়ার বেলায় আপনাদের উপস্থিতি, আপনাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য এটাই প্রমাণ দিচ্ছে, উনি মন্ত্রী না হন, সরকারে না যান, কিন্তু উনি মানুষের মনে আছেন, মানুষের মনে থাকবেন, এ দেশের মাটিতেই তিনি থাকবেন এবং আমাদের সবার মধ্যেই তিনি বিরাজ করবেন।’

শেষে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব শেষ হয়। এরপর মরদেহ নেওয়া হয় পোস্তগোলা মহাশ্মশানে। সেখানেই শেষকৃত্য হয়েছে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের।