নুরুল হককে কেন ছাড়লেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা

গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্যসচিব নুরুল হক
ফাইল ছবি

গণ অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং দলে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার পক্ষ নিয়েছেন। দল গঠনের শুরু থেকেই এই নেতারা দলের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই দুই নেতার বিরোধ যখন দলে বিভক্তি এনেছে, তখন নুরুল হকের দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী বা ঘনিষ্ঠদেরও তাঁর পক্ষত্যাগের ঘটনা নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নুরুল হকের ঘনিষ্ঠরা কেন তাঁকে ছেড়ে গেলেন, এই প্রশ্ন এসেছে আলোচনায়।

রেজা কিবরিয়ার পক্ষে গণ অধিকার পরিষদের যে নেতারা অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের দলছুট বলে উল্লেখ করেছেন নুরুল হক। তবে ওই নেতারা তাঁদের অবস্থান পাল্টানোর পেছনে বেশ কিছু কারণ তুলে ধরছেন। তাঁরা দলের আর্থিক অস্বচ্ছতাকে বড় কারণ হিসেবে বলছেন।

গণ অধিকার পরিষদে রেজা কিবরিয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়া নেতাদের মধ্যে দুজন যুগ্ম আহ্বায়ক ও একজন যুগ্ম সদস্যসচিবের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা নুরুল হকের পক্ষ ছাড়ার পেছনে দলের আর্থিক অস্বচ্ছতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অগণতান্ত্রিক মনোভাব, প্রতারণামূলকভাবে আহ্বায়ক পদ থেকে রেজা কিবরিয়াকে অপসারণ, ইসরায়েলের নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নুরুল হকের বৈঠক করার বিষয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া হুট করে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণ অধিকার পরিষদের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও তাদের ক্ষুব্ধ করেছে বলে তাঁরা জানান।

সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করে জনপ্রিয়তা পাওয়া নুরুল হক ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নুরুল হক ও তাঁর সমমনারা ২০২১ সালের অক্টোবরে গণ অধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

দলে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ কেন

রেজা কিবরিয়ার পক্ষ নেওয়া নেতারা অভিযোগ করেন, দল গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত দলের কোনো মাসিক সভায় আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়নি। প্রতি মাসেই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কেউ না কেউ এই প্রতিবেদন উপস্থাপনের তাগিদ দিতেন। কিন্তু প্রতিবেদন প্রস্তুত হচ্ছে, আগামী মাসে দেখানো হবে—এমন টালবাহানা করে সময় পার করা হয়েছে।  

এ বিষয়ে নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আর্থিক কমিটি রয়েছে। আর্থিক বিষয়ে বারবার আমাকে কেন টেনে আনা হয়। আমি তো সরাসরি এটার সঙ্গে জড়িতই না। আর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদনের সঙ্গে দলের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রতিবেদন হালনাগাদও রয়েছে।’

আহ্বায়ককে অপসারণ নিয়ে অসন্তোষ

গত ১ জুলাই শনিবার গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেই বৈঠকে নুরুল হকের নেতৃত্বে তাঁর সমর্থকেরা আহ্বায়কের পদ থেকে রেজা কিবরিয়াকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের পক্ষ থেকেই দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল।

দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান, মিয়া মশিউজ্জামান, সাদ্দাম হোসাইন, জাকারিয়া পলাশ, যুগ্ম সদস্যসচিব মোহাম্মদ আতাউল্লাহ, তারেক রহমান, আবুল কালাম আজাদ, আবু সাঈদ প্রমুখ। দল গঠনের শুরু থেকে এই নেতারা দলের পরিচিত মুখ।

রেজা কিবরিয়ার পক্ষ নেওয়া এই নেতারা অভিযোগ করেছেন, রেজা কিবরিয়ার অপসারণের সিদ্ধান্ত প্রতারণামূলকভাবে নেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগের পেছনে যুক্তি দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন, ১ জুলাইয়ের সভায় রেজা কিবরিয়াকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। মূলত নুরুল হক যেভাবেই হোক রেজা কিবরিয়াকে সরাতে চাইছিলেন।  

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গণ অধিকার পরিষদ নতুন দল হলেও একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। এই গঠনতন্ত্রে বলা আছে, সদস্যরা অনলাইনে সভায় অংশ নিতে এবং ভোট দিতে পারবেন। সেদিন সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাতজন স্বাক্ষর করেননি, অনলাইনে অংশ নেওয়া সদস্যরা তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। গায়ের জোরে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

সাফাদির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে ক্ষোভ

গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের অধিকাংশই মুসলিম দেশ ও নির্যাতিত মুসলমান হিসেবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। কিন্তু ইসরায়েলের নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে দলের সদস্যসচিব নুরুল হকের বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলটির নেতা–কর্মীদের অনেকেই। বিষয়টি নিয়ে নিজের আপত্তির কথাও জানান নুরুল হকের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া নেতারা।

তাঁরা অভিযোগ করেন, গত ১৮ জুন রেজা কিবরিয়ার বাসার ছাদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নুর কাতারে ইসরায়েলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও এ বৈঠকের আলোচ্যসূচি কী ছিল, তা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অবহিত করতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে নুরুল হক প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে ইসরায়েলি নাগরিকের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, আমার বৈঠক হয়নি। হোটেলে অনেক ভিড় ছিল, অনেকেই আমার সঙ্গে ছবি তুলেছে। আমি তো সাফাদিকে চিনতাম না। যে ছবিটির কথা বলা হচ্ছে, কখন তুলেছে, সেটা আমার বোঝার কথা নয়।’

অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ

২০২২ সালের ১৯ জুলাই একক স্বাক্ষরে প্রবাসী অধিকার পরিষদের কমিটি ঘোষণা করেন নুরুল হক। তিনি সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা। ওই দিনই প্রবাসী অধিকার পরিষদের আরেকটি অংশ পাল্টা কমিটি ঘোষণা করে। এ ঘটনার জেরে দলের যুগ্ম সদস্যসচিব মোহাম্মদ আতাউল্লাহসহ তিনজনকে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়।

নুরের পক্ষত্যাগকারী নেতাদের অভিযোগ, নুরুল হক অগণতান্ত্রিকভাবে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কেউ তার বিপক্ষে বললে নুরুল হকের কর্মী-সমর্থকেরা ওই নেতাকে নানাভাবে হেনস্তা করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নুরুল হকের সঙ্গে থাকা নেতারাও তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে পারেন না। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নুরুল হকের একচ্ছত্র প্রভাব। জেলা কমিটিসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটিও তিনি নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে করেছেন।

এসব অভিযোগের প্রসঙ্গে নুরুল হক বলেন, ‘দল আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে। নেতৃত্বের অগ্রভাগে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাঁরা এসব অভিযোগ করছেন, তাঁদের সঙ্গে তো অঙ্গসংগঠনেরও কেউ নেই। দল গঠনের আগে থেকেই প্রবাসী অধিকার পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা আমি। যাঁরা কমিটি গঠন নিয়ে অভিযোগ করছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ তো প্রবাসী অধিকারের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন।’

দলের কাউন্সিল নিয়ে টানাপোড়েন

নুরুল হকের সমর্থকেরা ১০ জুলাই দলের জাতীয় কাউন্সিলের ঘোষণা দিয়েছেন। রেজা কিবরিয়ার পক্ষ এই কাউন্সিল মানছেন না। তাঁদের অভিযোগ, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে কোটা আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা তরুণদের দল গণ অধিকার পরিষদে নুরুল হক নিজের একক আধিপত্য স্থায়ী করতে চাইছেন।  
তবে নুরুল হক মন্তব্য করেন, ‘নিজ দলের ভেতরেই খেলা চলছে।’ তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, ‘আহ্বায়ক পদে রেজা কিবরিয়াকে অপসারণের পর থেকে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। গণ অধিকার পরিষদকে ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে।’ দলে বিভক্তির পরও নুরুল হক ১০ জুলাই তাঁদের কাউন্সিল করবেন বলে জানান।  

অনেক দিন ধরে গণ অধিকার পরিষদের শীর্ষ দুই নেতাকে ঘিরে দলটিতে অস্থিরতা চলছিল। সম্প্রতি সেই অস্থিরতা প্রকট রূপ নিয়েছিল। দলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবকে পাল্টাপাল্টি অব্যাহতি, আহ্বায়ককে অপসারণের মতো ঘটনায় দলটি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

এরই মধ্যে গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়তে নোটিশ দিয়েছে ভবনের মালিকপক্ষ। গতকাল শুক্রবার পাঠানো ভবনের মালিকপক্ষের এ নোটিশে ভবন থেকে কার্যালয় সরানোর জন্য দুই দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য গণ অধিকার পরিষদ যে আবেদন করেছিল, সে আবেদনের তথ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ১০ জুলাই সরেজমিনে যাচাই করার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু দলটির দুই অংশের নেতাদেরই অনেকে বলছেন, রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকের বিরোধ থেকে গণ অধিকার পরিষদের দুটি পক্ষ যে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, সেখানে দুই পক্ষেরই অব্যাহত পাল্টাপাল্টি কর্মকাণ্ডে দলটিতে সংকট বেড়েই চলেছে।