সংস্কার প্রস্তাব গুছিয়ে এনেছে ছয় কমিশন

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির জন্য গঠন করা ১১টি কমিশনের মধ্যে প্রথমে গঠন করা ৬টি কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে। চলতি মাসের শেষ বা জানুয়ারির প্রথম দিকে সংস্কার কমিশনগুলো সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগেই পুরোনো আইনে পাঁচ বছরের জন্য গঠন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জনপ্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগ ও রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের পুরোনো প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে সংস্কারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কোনো কোনো সংস্কার কমিশনে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কিছু উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগও আছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার ঘোষণা দেয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। সেগুলো হলো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশনগুলোর প্রধানদের নামও ঘোষণা করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।

তবে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ করতে তিন সপ্তাহ সময় লেগে যায়। ৩ অক্টোবর পাঁচটি কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হয় ৭ অক্টোবর। এই কমিশনগুলোতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব না রাখায় সমালোচনা ছিল। গঠনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনগুলোকে সরকারের কাছে তাদের সংস্কার প্রস্তাব দিতে বলা হয়।

অন্যদিকে গত ১৭ অক্টোবর আরও চারটি সংস্কার কমিশন গঠনের কথা জানায় সরকার। সেগুলো হলো স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। তবে এই কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ হতে এক মাস লেগে যায়। গত ১৮ নভেম্বর এই চারটিসহ মোট পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অন্যটি হলো স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। নতুন এই কমিশনগুলোও কাজ শুরু করেছে। এই কমিশনগুলোকে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন দিতে হবে।

সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রথমে গঠন করা ছয়টি কমিশন পুরোদমে কাজ করছে। কমিশনগুলো সংবিধান, আইন-বিধি পর্যালোচনার পাশাপাশি অংশীজনদের মতামতও নিচ্ছে। এরই মধ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ডিজিটাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়ার পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও লিখিত মতামত নেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংস্কার বিষয়ে বিবিএসের মাধ্যমে সারা দেশে একটি জরিপ চালিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও একটি জরিপ চালানোর চিন্তা করছে। তারা ঢাকার বাইরে কয়েকটি বিভাগীয় শহরেও নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে। মতামত নেওয়ার পাশাপাশি এই দুটি কমিশন এখন পর্যন্ত যেসব মতামত পেয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে খসড়া সুপারিশ লেখার কাজও করছে। এই কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁরা সরকারের কাছে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিতে পারবেন বলে আশা করছেন।

অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন আশা করছে, আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তারা খসড়া প্রতিবেদন সরকারকে দিতে পারবে। এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল ৭ অক্টোবর। কমিটি গঠনের পরবর্তী ৯০ দিন হিসাবে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তাদের সময় থাকছে আগামী বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কাজ করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের কাছে খসড়া সুপারিশ দিতে পারবেন বলে আশাবাদী। তাঁরা বিবিএসের মাধ্যমে যে জরিপ চালিয়েছেন, এর ফলাফল এখনো হাতে পাননি। রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হবে, সেগুলো চিহ্নিত করে লেখা হচ্ছে। এর সঙ্গে জরিপের ফলাফল এলে তা মিলিয়ে দেখা হবে বাড়তি কিছু আসে কি না।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে অংশীজন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করছে, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এবং লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়েছে।

‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে অনলাইনে সাধারণ মানুষের মতামত নিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পুলিশ সদর দপ্তরের কাছেও সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম এবং অন্যান্য দেশের পুলিশ কীভাবে কাজ করে, সেসবও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে দলীয় প্রভাবমুক্ত যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের আইন করা; পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কার্যকর সহযোগিতার প্রক্রিয়া কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়—এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে এ–সম্পর্কিত সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সব মতামত পর্যালোচনা করে তাঁরা একটি জায়গায় পৌঁছেছেন। তাঁরা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তাব পেশ করবেন।

উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতি ঠিক করা। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এখন পর্যন্ত তাদের প্রস্তাব তৈরি করেনি। কিন্তু এর মধ্যে সরকার নতুন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। এটি করা হয়েছে ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের আমলে করা আইনে। আইনটি নিয়েই বিতর্ক আছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কারের জন্য সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে একটি খসড়াও তৈরি করেছে। কিন্তু সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। ইতিমধ্যে পুরোনো প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন ও বিধিমালা সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। একই কাজ করছে সংস্কার কমিশন। এটি নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানের মাছউদ প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের কমিটি গঠন করা হলেও তাঁরা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করবেন।

একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনে কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কারের কথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। দুদক সংস্কার কমিশনও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু এর মধ্যে দুদকে নতুন চেয়ারম্যান ও দুজন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও দুদকের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পুরোনো পদ্ধতিতে নিয়োগের ফলে সংস্কারপ্রক্রিয়া আসলে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য সংবিধানে একটি আইন করার কথা থাকলেও কোনো সরকার সে আইনটি করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারও কোনো অধ্যাদেশ করেনি বা সরকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করেনি। পুরোনো পদ্ধতিতেই বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন নিয়ে গত ১৮ নভেম্বর নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিল দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘সংস্কার কমিশনের কাজ শেষ না হতেই নতুন নিয়োগের উদ্যোগে (নির্বাচন কমিশন ও দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এখনো তাদের প্রস্তাব তৈরি করেনি। কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ পদে চলছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। টিআইবি বলেছে, রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া বা না দেওয়ার চর্চা অব্যাহত রয়েছে।

এখন এই সংস্কার কমিশনগুলো প্রস্তাব তৈরির পর অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। তবে প্রস্তাবগুলো কীভাবে কার্যকর করা হবে, এগুলো কার্যকর করার পর নির্বাচন হবে নাকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে এগুলো বাস্তবায়ন করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।