ময়মনসিংহে নির্বাচিত মেয়র ইকরামুল হক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানকে ঘিরে সেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। এর প্রভাব সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দেখা গেছে।
সিটি করপোরেশনের অন্তত ২০টি ওয়ার্ডে নিজেদের লোককে কাউন্সিলর পদে জিতিয়ে আনতে প্রচারে নেমেছিলেন সদর আসনের সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানের (শান্ত) সমর্থকেরা। তবে ভোটের ফলাফল বলছে, ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয়ী হয়েছেন মোহিতের অনুসারী হিসেবে পরিচিতরা। বাকি ২২টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছেন পুনরায় নির্বাচিত মেয়র ইকরামুল হকের (টিটু) অনুসারীরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের অনেকে বলছেন, ইকরামুল হকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের জয়ের চেষ্টার পাশাপাশি মেয়র পদেও ভোট করেছেন। ফলে মেয়র পদে ইকরামুলের বিশাল ব্যবধানে জয় পাওয়া সহজ হয়েছে। অন্যদিকে মোহিতের সমর্থকেরা নিজেদের কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে যতটা সরব ছিলেন, মেয়র পদে অন্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে সেভাবে মাঠে ছিলেন না। ফলে ইকরামুলের বিপক্ষে প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগের অন্য দুই নেতা হেরেছেন লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে।
গত শনিবার ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক পুনরায় নির্বাচিত হন। তিনি পান ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬০৪ ভোট। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান ৩৫ হাজার ৭৬৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। আর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেসামুল আলম পান ১০ হাজার ৭৭৩ ভোট। এহতেসামুল তাঁর জামানত হারিয়েছেন।
ভোটে ইকরামুলের বিপক্ষে ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতার এমন ফলাফল আলোচনার তৈরি করেছে। তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও ভোটারদের মতে, নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকেই এমন ফলাফলের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। প্রচারেও ইকরামুল অন্য প্রার্থীদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ২০১৯ সালের ৫ মে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন ইকরামুল হক। এবার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি।
শুরুতে ইকরামুলের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের চার নেতা মেয়র পদে দাঁড়ান। পরে একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয় ও একজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেসামুল আলম।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ভোটাররা বলছেন, দীর্ঘদিন দলের রাজনীতি করলেও সাদেকুল ও এহতেসামুল দুজনেরই জনসম্পৃক্ততা কম। সমঝোতার মাধ্যমে তাঁদের একজনকে বসিয়ে দিয়ে ইকরামুলের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান তাঁদের কাউকে সেভাবে সমর্থন না দেওয়ায় বেকায়দায় পড়েন তাঁরা। তবে ভোটের আগে সাদেকুল ও তাঁর লোকজন প্রচার করেন সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন।
এহতেসামুল আলম নিজের কেন্দ্র মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে মাত্র ১৭১ ভোট পেয়েছেন। এই কেন্দ্রে ইকরামুল হক ভোট পেয়েছেন ১ হাজার ১৭৬টি।
ভোটের ফলাফলের বিষয়ে এহতেসামুল আলম গতকাল রোববার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচারে অনেক সাড়া ছিল। সেখানে এত কম ভোট পাওয়া মানে কিছু একটা তারা (ইকরামুল) করেছে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে আমি নাকি শূন্য ভোট পেয়েছি। সেখানে তো আমার এজেন্ট ছিল, তাদের ভোট কোথায় গেল?’
দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, কাউন্সিলর ও পরে মেয়র হিসেবে দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি থাকায় মেয়র ইকরামুল হকের জনসম্পৃক্ততা ছিল। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় দলেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব আছে। তাঁর বিপরীতে দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় এবং তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করায় তাতে লাভ হয়েছে ইকরামুলের।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী আজাদ জাহান প্রার্থী এহতেসামুলের পক্ষে ছিলেন। কাজী আজাদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র পদে ইকরামুল অন্যদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ইকরামুলের পক্ষে ছিলেন। ইকরামুলের বিপরীতে একক প্রার্থী দিতে পারলে ফলাফল আরও ভালো হতো।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মোহিত উর রহমান। নির্বাচনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন মেয়র ইকরামুলের বড় ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হক। ভোটে আমিনুল হক হেরে যান মোহিতের কাছে।
মোহিতের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক অনুসারীদের হিসাবে, বিগত সংসদ নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের ২২ জন কাউন্সিলর মোহিত উর রহমানের বিপক্ষে কাজ করেন। বাকিদের প্রায় সবাই নৌকার পক্ষে ছিলেন। সংসদ নির্বাচনে যেসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করেছিলেন, সিটি নির্বাচনে সেসব ওয়ার্ডে নিজেদের প্রার্থী দেন মোহিতের সমর্থকেরা। তাঁরা বর্তমান কাউন্সিলর ও নতুন প্রার্থী মিলিয়ে অন্তত ২০টি ওয়ার্ডে নিজেদের লোককে কাউন্সিলর নির্বাচিত করতে চেষ্টা চালান।
কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকায় ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১১ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ফরহাদ আলম। সর্বশেষ সিটি করপোরেশনেও তিনি কাউন্সিলর ছিলেন। ফরহাদ আলম বিএনপির অনুসারী।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনর ৩৩টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মোট ৮ জন নতুন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বাকি ২৫ জনই সর্বশেষ মেয়াদে কাউন্সিলর ছিলেন। পুরোনো কাউন্সিলরদের মধ্যে অধিকাংশই মেয়র ইকরামুল হকের অনুসারী।
ইকরামুল ও মোহিতের অনুসারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১১টি ওয়ার্ডে মোহিতের অনুসারীরা কাউন্সিলর হয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন নতুন প্রার্থী ও আটজন আগেও কাউন্সিলর ছিলেন। তবে মোহিতের অনুসারীদের একটা অংশের দাবি, ১৫টি ওয়ার্ডে তাঁদের লোক কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ইকরামুল হকের বিপরীতে প্রার্থী হওয়া সাদেকুল ও এহতেসামুল বড় নেতা হতে পারেন, কিন্তু জনগণের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না। ফলে ইকরামুল ও তাঁর অনুসারীরা ভোটে ভালো করেছেন।