ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩২ বছর আগে আজকের এই দিনে গণ-আদালত বসিয়ে বিচার করা হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের। কীভাবে গঠিত হয়েছিল গণ-আদালত, এর পটভূমি কী ছিল, এ নিয়েই এই প্রতিবেদন।
৩২ বছর আগে আজকের এই দিনে গণ-আদালত বসানো হয়েছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সেই গণ-আদালতে মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার করা হয়েছিল।
গৌরবময় স্বাধীনতা দিবসকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিচারের জন্য। এর আগপর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত কোনো আন্দোলন ছিল না। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সেই গণ-আদালত থেকেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের বিষয়টি সামনে আসে।
সে সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি সরকার গণ-আদালতের পক্ষে ছিল না। ঢাকায় কোনো রকম জমায়েত-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে জারি করা হয়েছিল ১৪৪ ধারা। সেই নিষেধাজ্ঞা, পথে পথে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করেই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ; বসেছিল গণ-আদালত।
গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধের প্রতীকী বিচার করার এই আন্দোলন হঠাৎ করেই হয়নি। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বিশিষ্ট কিছু নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এর পেছনে সক্রিয়ভাবে ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এমন একটি বড় আন্দোলনে পটভূমিও তখন তৈরি হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পত্র-পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে তাদের আমির ঘোষণা করেছে। তখন তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের প্রতীকী বিচারের গণ-আদালত।
গণ-আদালতের অন্যতম একজন সংগঠক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণার ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। সেই পটভূমিই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে শাহরিয়ার কবির উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গোলাম আযমের পাসপোর্ট বাতিল করেছিল।
১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্টে তিন মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে থেকে গিয়েছিলেন। এর ১৩ বছর পর ১৯৯১ সালে তাঁকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করার পর তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যদিও এর আগে তিনিই জামায়াতের অঘোষিত আমির ছিলেন। তখন দলটি তাদের আরেক নেতা আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে সামনে রেখেছিল। এটি তাদের কৌশল ছিল। তবে গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে জামায়াতের আমির ঘোষণা করার ঘটনা বিতর্কের জন্ম দেয়।
গণ-আদালত করে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের রায় ঘোষণার পরদিনই জাহানারা ইমামসহ এর সংগঠক ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী একজন ব্যক্তি ও যুদ্ধাপরাধী দেশে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারেন না। এই বক্তব্য নিয়ে তখন সংসদে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা এর প্রতিবাদ করেন।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘ঘটনার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকেই প্রতিবাদ হতে থাকে। তখন আমরা প্রতিবাদকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামানের বাসায় কয়েক দফা বৈঠক করলাম। আমরা একমত হলাম যে বিচ্ছিন্নভাবে না করে বড় একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন।’
প্রথমে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিক মিলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয় ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি। এই সংগঠন গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির করার ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গোলাম আযমের বিচারের দাবি তুলে সংগঠনটি আন্দোলনে নামে।
সেই আন্দোলনে অল্প সময়ের মধ্যেই ১৪টি ছাত্রসংগঠন, আওয়ামী লীগসহ ১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন—সব মিলিয়ে ৭২টি সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটি। এই সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
শাহরিয়ার কবির বলেন, সমন্বয় কমিটি ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে। একপর্যায়ে তৎকালীন সরকারকে গোলাম আযমের বিচার করার জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে সরকার পদক্ষেপ না নিলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিচার করা হবে, এটিও ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু সমন্বয় কমিটির এই ঘোষণার মুখে তৎকালীন সরকার ওই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, সে সময় বিএনপি সরকার ২৪ মার্চ একদিকে গণ-আদালত বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছিল, অন্যদিকে গোলাম আযমকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ওই আন্দোলনের মুখে গোলাম আযমকে ১৯৯২ সালে ২৪ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সেই গণ-আদালতই ছিল বড় ধরনের সংগঠিত আন্দোলন এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হয়আফসান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘গণ-আদালত আইনসম্মত নয় এবং সংবিধানবিরোধী বলেও তৎকালীন সরকার অভিযোগ করেছিল। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, গণ-আদালত আইনসম্মতভাবেই প্রতীকী বিচার করবেন। এটি সংবিধান ও আইনসম্মতভাবেই হবে।’
সরকারের এমন অবস্থানের কারণে গণ-আদালতে লোকসমাগম নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন সংগঠকেরা। শাহরিয়ার কবির জানান, মূল কর্মসূচির দুই দিন আগে তাঁরা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে লোকসমাগমের বিষয়ে আলোচনা করেন। শেখ হাসিনা তাঁদের লোকসমাগমের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দুই দিন আগে থেকেই রাজধানীকে পুলিশ দিয়ে দেশের অন্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, ঢাকার বাইরে থেকে যাতে লোক আসতে না পারে। আর কারফিউ না দিলেও ঢাকা নগরীর ভেতর সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ছিল। নগরীতে কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া হয়নি।
শাহরিয়ার কবির জানান, একটা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে সেদিন জমায়েত হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
আগের দিনেই পুলিশ মঞ্চ ভেঙে নিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া কলরেডির ৫০০ মাইক লাগানো হয়েছিল, সেগুলোও সব পুলিশ খুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন শাহরিয়ার কবির।
গণ-আদালত আইনসম্মত নয় এবং সংবিধানবিরোধী বলেও তৎকালীন সরকার অভিযোগ করেছিল। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, গণ-আদালত আইনসম্মতভাবেই প্রতীকী বিচার করবেন। এটি সংবিধান ও আইনসম্মতভাবেই হবে।শাহরিয়ার কবির, গণ-আদালতের অন্যতম সংগঠক
সকালে জাহানারা ইমামসহ আন্দোলনের নেতারা সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা ড. কামাল হোসেন, আমীর–উল ইসলামসহ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে গণ-আদালতের আইনগত বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করেছিলেন। সেখানেই প্রতীকী বিচারের রায়ে স্বাক্ষর করা হয়েছিল।
তবে পুলিশি বাধা ও পরিস্থিতি সামলে সমন্বয় কমিটির নেতাদের গণ-আদালত শুরু করতে দুপুর হয়ে যায়। বার কাউন্সিল থেকে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ-আদালতের অন্যরা দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যান। সেখানে মঞ্চ না থাকায় তাঁরা একটি ট্রাকে দাঁড়িয়ে গণ-আদালত শুরু করেন।
গণ-আদালতের একাধিক সংগঠক বলেছেন, একটি আদালতে বিচারের জন্য যেসব বিষয়ের প্রয়োজন হয়, তার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছিল। বিচারকদের একটি প্যানেল করা হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত, অভিযোগকারী, সাক্ষী ও প্রসিকিউশন রাখা হয়েছিল। আসামি উপস্থিত না থাকলে তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনজীবী দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। গণ-আদালতে গোলাম আযমের পক্ষেরও একজন আইনজীবী রাখা হয়েছিল।
সব প্রস্তুতি রাখা হলেও সেগুলো পালন করা সম্ভব হয়নি। জাহানারা ইমাম ও অন্যরা সমাবেশে একটি ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে গণ-আদালত শুরু করেন। কিন্তু মাইক না থাকায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েতে নেতারা হ্যান্ড মাইকে কথা বলেন। এমন পরিস্থিতিতে অন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা না করে জাহানারা ইমাম প্রতীকী বিচারের রায় পড়ে শোনান।
এরপর সেই ট্রাকের কাছ থেকে পুরো সমাবেশে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে যে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় হয়েছে।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘সেখানে আসলে কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। আমরা গোলাম আযমকে ১০টি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করি, সব কটি অপরাধই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। এটি বলে প্রতীকী বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। মাইক না থাকায় ফাঁসি দেওয়ার বিষয়টিই ছড়িয়ে পড়ে।’
একটি আদালতে বিচারের জন্য যেসব বিষয়ের প্রয়োজন হয়, তার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছিল। বিচারকদের একটি প্যানেল করা হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত, অভিযোগকারী, সাক্ষী ও প্রসিকিউশন রাখা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষক আফসান চৌধুরী সেদিন গণ-আদালতে প্রতীকী বিচার দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণ-আদালতে অংশ নেওয়া মানুষের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখেছিলেন। সেই গণ-আদালতই ছিল বড় ধরনের সংগঠিত আন্দোলন এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হয় বলে তিনি মনে করেন।
গণ-আদালত করে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের রায় ঘোষণার পরদিনই জাহানারা ইমামসহ এর সংগঠক ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেই মামলা বাতিল করা হয়। তবে এর আগেই ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে ক্যানসারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ওই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি জাহানারা ইমাম।
গণ-আদালতকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। জেলায় জেলায় একাত্তরের ঘাতক দালার নির্মূল কমিটি গঠিত হয়েছিল। একপর্যায়ে সেই আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শীর্ষ অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার দুই বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করেছিল ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এর পর থেকে গোলাম আযমসহ জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের পর্যায়ক্রমে বিচার করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে।