ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের নেতাদের চীনমুখী তৎপরতা বেড়েছে। কয়েক বছর ধরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফর করছেন ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা। তবে এবার তাঁদের চীন সফর বেড়েছে।
গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের ৯ সদস্যের একটি দল চীনে গেছে। এতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারসহ শীর্ষ নেতারা রয়েছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ২৫ মে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের ৫০ সদস্যের একটি বড় দল চীন সফরে যাবেন। এই দলটির নেতৃত্ব দেবেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও সংসদ সদস্য সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ তানভীর শাকিল জয়।
১৪ দলের বামপন্থী শরিকদের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আগে থেকেই একধরনের যোগাযোগ ছিল। নেতাদের সফরও নিয়মিত হতো।
২৫ জুন আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি দলের চীন সফরের কথা রয়েছে। এই দলটির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গঠিত দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহকে। এই দলটির সদস্যসংখ্যাও ১০ জনের মতো হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
১৪ দলের বামপন্থী শরিকদের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আগে থেকেই একধরনের যোগাযোগ ছিল। নেতাদের সফরও নিয়মিত হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গেও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সখ্য বেড়েছে বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আগ্রহই বেশি। ২০১২ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বহুবার চীন সফর করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মন্ত্রী সং তাও এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ সমঝোতা স্মারকে সই করেন। বাংলা, চায়নিজ ও ইংরেজি ভাষায় এই স্মারক সই করা হয়।
২০১৯ সালের ২১ মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। আওয়ামী লীগের আমন্ত্রণে সে সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মন্ত্রী সং তাও এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ সমঝোতা স্মারকে সই করেন। বাংলা, চায়নিজ ও ইংরেজি ভাষায় এই স্মারক সই করা হয়।
এতে বলা হয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, সমঅধিকার, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ের হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে দুই বন্ধুপ্রতিম দল পারস্পরিক বিনিময় ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দলীয় সম্পর্ক এবং ‘চীন-বাংলাদেশ কৌশলগত সহায়তা ও অংশীদারত্ব’ আরও জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করবে। দুই সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলোচনা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে যোগাযোগ ও সহায়তা জোরদার করারও কথা বলা হয়।
২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর প্রয়াত সদস্য আবদুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে ২০ সদস্যের দল চীন সফর করে। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এই অঞ্চলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেসের সম্পর্ক প্রাচীন। এই সম্পর্ক এখনো অটুট। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গেও যোগাযোগ বেড়েছে। তাদের আমন্ত্রণে বেশ কয়েকবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সফর করেছেন। সরকারিভাবেও সফর বিনিময় হয় নিয়মিত। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগটা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক বেড়েছে।
২৪ মে ৫০ সদস্যের দলটি যাচ্ছে চীনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ঝেজিয়াংয়ে। এর সদস্যরা মূলত ছাত্র ও যুবনেতা। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের আমন্ত্রণপত্রে ছাত্র, যুব ও নারী নেতাদের প্রশিক্ষণের কথা বলেছে। এই জন্য এই দলের সদস্যদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের তথ্যভান্ডার তৈরিতে যুক্ত ওয়েব টিমের সদস্যরাও থাকবেন। এঁরাও ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এই দলটির নেতৃত্ব দেবেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও সংসদ সদস্য সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ তানভীর শাকিল জয়।
তানভীর শাকিল জয় প্রথম আলোকে বলেন, মূলত আওয়ামী লীগ ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংস্কৃতির আদান-প্রদান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ই মূল লক্ষ্য। সফরে কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, এরপর ২৫ জুন কাজী জাফর উল্যাহর নেতৃত্বে যে দলটি যাবে, সেটিতে কেন্দ্রীয় নেতারাই থাকবেন। এই দলটির সদস্যসংখ্যাও ১০ জনের মতো হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
গত বছর ২২ মে এবং ৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা দুবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে সে দেশ সফর করেন। ফারুক খান এর আগেও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে চীন সফর করেছেন।
২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর প্রয়াত সদস্য আবদুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে ২০ সদস্যের দল চীন সফর করে। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক কাজের জন্য কম্পিউটারসহ নানা সামগ্রী উপহারও দিয়েছে।
গতকাল দুপুরের পর চীন সফরে গেল জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দলের ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। তাদের গন্তব্যস্থল চীনের কুংমিং প্রদেশ।
এই দলে আছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, জাসদের কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম, জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ মোহসীন, ওয়ার্কার্স পার্টির নারী নেত্রী লুৎফুন্নেছা খান, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য মোস্তফা লুৎফুল্লাহ, সাম্যবাদী দলের নেতা তৃপ্তি বড়ুয়া, হ মোশায়হিদ প্রমুখ। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রতিনিধিদলকে বিদায় জানান।
সফরকালে ১৪-দলীয় জোটের তিন শরিক দলের নেতারা কুংমিংয়ে ইউনান একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচার সায়েন্স একাডেমি, কেপিসি ফার্মাসিউটিক্যালস পরিদর্শন করবেন। সফরকালে তাঁরা চীনের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক হতে পারে। এমনকি সফরকালে নেতাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে গত বছর জুলাইয়ে ১৪ দলের বামপন্থী শরিকদের শীর্ষ নেতারা চীন সফর করেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ১৪ দলের শরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে জোটের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক চেয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বৈঠকের জন্য ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু শরিক দলের নেতাদের চীন সফরের কারণে বৈঠকটি কয়েক দিন পেছাতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।