মতিউর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদন

এরশাদের শেষ ষড়যন্ত্র

আজ ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস। গণ-আন্দোলনের মুখে ৩৩ বছর আগে ১৯৯০ সালের এই দিনে পদত্যাগ করেন তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টায় শেষ মুহূর্তেও ষড়যন্ত্র করেছিলেন তিনি। ‘এরশাদের শেষ ষড়যন্ত্র’—এই শিরোনামে মতিউর রহমান প্রথম আলোয় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট। সেই লেখাটি আজ আবার প্রকাশ করা হলো।

হাইকোর্টের গত বৃহস্পতিবারের রায়ের পর এ দেশে শাসক হিসেবে বাতিল হয়ে গেলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এখন তাঁর একমাত্র পরিচয় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরশাসক। পরিহাসের বিষয়, এই এরশাদই এখন বড় গলায় হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু এ জন্য অনুশোচনার লেশমাত্র নেই তাঁর মধ্যে। বরং সেদিনই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে তিনি প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, কতটা নিরুপায় হয়ে তাঁকে দেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। কতটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যের কারণে তাঁকে নয়টি বছর ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে! কিন্তু তাঁর এই কথাগুলো কতটা অসার, তা তাঁর ক্ষমতা থেকে বিদায়ের দিনগুলোর ঘটনাবলির দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর আজ তাঁর এসব কথা বলার সুযোগ পাওয়ার দায় আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এড়াতে পারেন না।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরশাদ অনেক মামলায় অভিযুক্ত হয়েও বছরের পর বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে, রাজনীতি করছেন, সংসদে বসছেন। প্রথম বিএনপি (১৯৯১—৯৬) সরকারের আমলে কোনো একটি মামলায় জামিন না পেলেও আওয়ামী লীগ (১৯৯৬—২০০১) সরকারের আমলে সব কটিতেই জামিন পেয়েছিলেন। সে সময়ের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘ঐকমত্যের’ সরকারেও ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এবারও রয়েছে সরকারের ‘মহাজোটে’র অংশ হয়ে।

আমরা জানি, এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দীর্ঘ লড়াই করেছে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া যুগপত্ গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ ও জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬-এর নির্বাচনে দেশের দুই নেত্রীই এরশাদের সমর্থনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সাহায্য করেছিলেন। পরে আবার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে যান এককভাবে।

১৯৯০-এর ডিসেম্বরে দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এরশাদকে আর সমর্থন করতে পারেনি। সে জন্য ১৯৯০-এর ৪ ডিসেম্বর যেদিন এরশাদ জানতে পারলেন যে সেনাবাহিনী আর তাঁকে সমর্থন করছে না, সেদিন রাতেই এরশাদ তাঁর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। ৪ ডিসেম্বর রাতে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেও এরশাদ সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, সামরিক শাসন জারি এবং দেশত্যাগসহ নানা বিকল্পের কথা ভেবেছিলেন। নানা রকম অপতত্পরতায় লিপ্ত ছিলেন পরের দুই দিন। এরশাদ তাঁর শাসনকালের শেষ দিনগুলোতে কী পরিকল্পনা করেছিলেন, সে সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, সে প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা যায়।

আমরা জানি, নব্বইয়ের ৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করার ঘোষণা দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী রওশন, ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম মাইলামের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে এরশাদের তত্কালীন সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) মঞ্জুর রশীদ খান লিখিত এরশাদের পতন ও সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী শাসন: কাছ থেকে দেখা (অঙ্কুর প্রকাশনী, ১৯৯৬) গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ আছে।

কিন্তু তার পরও ৩ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পদত্যাগের প্রস্তাব করেন। দেশের বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব এরশাদের নতুন প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

সেদিন ৩ ডিসেম্বর সকালেই এরশাদ সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তরে তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন এবং রাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘোষণা দেবেন বলে জানান। আসলে এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর প্রতি যে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন রয়েছে, সেটা দেশবাসীকে দেখানো।

সেদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এরশাদ প্রেসিডেন্ট অফিসে বেশ তত্পর ছিলেন। সকালেই ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চলে আসেন সেখানে। দুই ঘণ্টা ধরে তাঁদের মধ্যে সলাপরামর্শ চলে। একপর্যায়ে তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান শেলীও এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

সেদিন সারা দিনই মওদুদ আহমদ এবং দুই মন্ত্রী প্রেসিডেন্ট অফিসে ছিলেন। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁরা বক্তৃতা লেখালেখির বিষয়টি শেষ করে এরশাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। শেষ দিনগুলোতে এটা দেখা গেছে যে রাজনৈতিক বিষয়ে মওদুদ আহমদ এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ওপরই এরশাদ নির্ভর করেছেন বেশি। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় প্রেসিডেন্ট অফিসে হালকা প্রসাধনী নিয়ে এরশাদ রেডিও-টেলিভিশনের জন্য ১৩ মিনিটের বক্তৃতাটি রেকর্ড করেন। তারপর সন্ধ্যার পর এরশাদ তাঁর সব মন্ত্রীকে ডাকেন আলোচনার জন্য। মন্ত্রীরা সবাই ছিলেন বেশ উত্তেজিত এবং ভীতসন্ত্রস্ত। এরশাদ তাঁর বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত ভাষ্য তাঁদের জানিয়ে দেন। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কেও কিছু বলেন। মন্ত্রীদের দ্রুত বাসায় ফিরে গিয়ে টেলিভিশনে এরশাদের বক্তৃতা শুনতে বলা হয়। কারণ, ইতিমধ্যে রাত ১০টা বেজে গিয়েছিল। মন্ত্রীরা একে একে চলে গেলেও দু-তিনজন মন্ত্রী এরশাদের সঙ্গে থেকে যান।

এরশাদ এবং তাঁর পরামর্শদাতারা ভেবেছিলেন যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সাধারণ নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পদত্যাগের প্রস্তাবে গণ-আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে। বিরোধী দলও তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হবে। এরশাদ আরও কিছুটা সময় পেয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর প্রস্তাব তাত্ক্ষণিকভাবেই বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ৪ ডিসেম্বর সকালেও সচিবালয়ে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, দু-তিন দিনের মধ্যে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এরশাদের বক্তৃতা মানুষ মেনে নেবে।

৪ ডিসেম্বর সকালে রাষ্ট্রপতি এরশাদ যখন আগের রাতের বক্তৃতা সম্পর্কে মানুষ ও বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করছেন, তখন সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠক চলছিল। সেখানে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

আলোচনায় উপস্থিত অনেকেই সমগ্র পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কয়েকজন প্রশ্ন তোলেন, কেন সামরিক বাহিনী এরশাদকে সমর্থন করে যাবে? তাঁরা বলেন, এরশাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য সমগ্র দেশ এখন সামরিক বাহিনীকে দায়ী করছে। তাঁকে আর কোনো রকম সহযোগিতা দেওয়া হবে না। সকালে সেনা সদর দপ্তরে অফিসারদের বৈঠকে এ রকম মতামতই প্রকাশ পেয়েছিল। মেজর জেনারেল (অব.) মঞ্জুর রশীদ খান সেনাবাহিনীর এই মনোভাব এরশাদকে দুপুরে জানিয়ে দেন।

এরশাদকে সামরিক বাহিনীর মনোভাবের কথা জানালে তাঁর প্রশ্ন ছিল, এখন ওরা আমার বিরুদ্ধে কেন? সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরের প্রতিক্রিয়া জেনে তিনি তখন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। কেননা তাঁর শেষ ভরসা ছিল সামরিক বাহিনীর ওপর। আর সামরিক বাহিনীর ভয় ছিল, যদি দেশের মানুষের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করতে কোনো মরিয়া চেষ্টা নেন এরশাদ, তাহলে কী হবে! এ ব্যাপারে মঞ্জুর রশীদ খানের বইয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। মঞ্জুর রশীদের কাছ থেকে জানার পরও এরশাদ তত্কালীন সিজিএস মেজর জেনারেল আবদুস সালামের কাছ থেকেও সেনাবাহিনী ও সেনা নেতৃত্বের মনোভাব জেনেছিলেন।

সামরিক বাহিনীর মনোভাব জানার পরও সেদিন (৪ ডিসেম্বর) অপরাহ্নে কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। এরশাদ শেষবারের মতো বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে কোনো রকম একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন বলে জানা যায়। সে জন্য কয়েকজন মন্ত্রীকে কাজে লাগানো হয়েছিল। সেই সন্ধ্যায় অবরুদ্ধ সচিবালয়ে বসেও এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে টেলিফোনে এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

সেদিন ৪ ডিসেম্বর সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা শহরসহ দেশের সব শহরে হাজার হাজার মানুষের জঙ্গি মিছিল ছিল। তিন জোটের সমন্বিত কর্মসূচিতে দেশ অচল হয়ে পড়ে। সরকারি প্রশাসন কাজ বন্ধ করে দেয়। দাতা দেশ এবং বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোও সরকারের ওপর তাদের অনাস্থা প্রকাশ করে।

সেদিন সন্ধ্যার পর এরশাদ তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে তাঁর সেনাভবনের বাসগৃহে ডেকে পাঠান। তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ তখন টেলিভিশনে আগের রাতে দেওয়া এরশাদের বক্তৃতার ‘শাসনতান্ত্রিক ব্যাখ্যা’ তুলে ধরে মানুষকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। তারপর তিনিও টেলিভিশন থেকে সরাসরি এরশাদের বাসায় চলে যান। সেখানে বহুক্ষণ ধরে তিনজনের মধ্যে সলাপরামর্শ চলে। একপর্যায়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঘর থেকে বের হয়ে এসে টেলিভিশনে সরাসরি ফোন করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করতে বলে দেন এবং তাত্ক্ষণিকভাবেই তা রাত ১০টার খবরে প্রচার করা হয়। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নেমে আসে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই। মানুষ ছুটে চলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, প্রেসিডেন্ট অফিস, ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর দিকে। এ রকম অবস্থায় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেশের বিরোধীদলীয় নেতৃত্বের সহযোগিতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আবদুস সালাম পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান নেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুর রশীদ বিপদের মুখেও বঙ্গভবন থেকে সেনাভবনে চলে আসেন। সেনা নেতৃত্ব শহরের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়ে দেন।

এদিকে রেডিও-টেলিভিশনে এরশাদের ঘোষণার পর থেকে তাঁর বাসায় মন্ত্রীদের ভিড় জমতে থাকে। তাঁরা একে একে অত্যন্ত বিমর্ষ, ভীত অবস্থায় তাঁর বাসভবনে আসেন। গভীর রাতে এরশাদ সমবেত মন্ত্রীদের নিয়ে বসেছিলেন এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। কয়েকজন মন্ত্রী এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ, মন্ত্রীদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান, আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ আরও কয়েকজন। আরও ছিলেন বেগম রওশন এরশাদ এবং তাঁর ভগ্নিপতি মোস্তাফিজুর রহমান। সবাই তখন ছিলেন ভীতসন্ত্রস্ত। বাইরের সমস্ত পরিস্থিতি জেনে নিয়ে এরশাদ মন্ত্রীদের নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। মন্ত্রীদের ইচ্ছানুযায়ী ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, বনানী আর গুলশানে তাঁদের গোপন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়ে আসা হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিশেষ প্রহরায়।

৩ ও ৪ ডিসেম্বরে এরশাদের কার্যক্রম সম্পর্কে মওদুদ আহমদের চলমান ইতিহাস গ্রন্থের ৪৭৯—৪৮১ পৃষ্ঠায় কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।

ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও নব্বইয়ের ৫ ডিসেম্বর এরশাদ ভয়ংকর এক পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই দেশে সামরিক শাসন জারি করে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা ছিল এরশাদের। এরশাদের সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মঞ্জুর রশীদ খান এমন আশঙ্কার কথা বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর বইয়ে।

সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে সময়োচিত সিদ্ধান্ত এবং পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এরশাদের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। সেদিন সন্ধ্যা ও রাতে ঢাকায় সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল। এরশাদের অনুগত কতিপয় অফিসারের ওপর কড়া নজর রাখা ও তাঁদের যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সে সময় সক্রিয় ও একাধিক রাজনৈতিক ও বৃহত্ ব্যবসায়ী সূত্রেও এসব তথ্য জানা যায়।

৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ সন্ধ্যায় এরশাদের সেনাভবনের বাসগৃহে ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ এবং মন্ত্রী নাজিউর রহমানসহ পাঁচ-ছয়জন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। এরশাদের সহযোগীদের ওই বৈঠকে সবচেয়ে বিস্ময়কর উপস্থিতি ছিল সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) আতিকুর রহমানের। তাঁদের উপস্থিতিতে এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান লে. জে. মোহাম্মদ নূরউদ্দীন খান এবং সিজিএস মেজর জেনারেল আবদুস সালামকে সেখানে নেওয়ার জন্য সন্ধ্যা থেকে বারবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেন এরশাদ। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন বহুভাবে। কিন্তু সেনা নেতৃত্ব বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে তাঁরা সেখানে উপস্থিত হলে তাঁদের দিয়ে দেশে সামরিক শাসন জারি এবং অন্যান্য নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা হবে। যার অর্থ ছিল দেশে এক গণহত্যার সূচনা ঘটানো।

এরশাদের এই সম্ভাব্য পরিকল্পনা তাঁরা সেদিন (৫ ডিসেম্বর) বিকেলেই জানতে পারেন। সে জন্য এরশাদের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেনা নেতৃত্ব তাঁর বাসভবনে যাননি। অন্যদিকে এরশাদ তাঁর বিশেষ অনুগত অফিসারদেরও খুঁজছিলেন। বিশেষ করে, সে সময় নবম ডিভিশনের কমান্ডার এরশাদের বিশ্বস্ত মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামকে তিনি খোঁজ করছিলেন। এরশাদ বলেছিলেন, ‘রফিক আমার জন্য সবকিছু করতে পারে।’ এরশাদের শেষ ভরসা ছিল, রফিক অবশ্যই সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। এখানে বিশেষ উল্লেখ্য যে এরশাদ তখনো দেশের প্রেসিডেন্ট এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে সব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর পক্ষে এ ধরনের মরিয়া পদক্ষেপ গ্রহণের প্রচেষ্টা নেওয়া অসম্ভব ছিল না।

৫ ডিসেম্বর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত এরশাদ সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মঞ্জুর রশীদ খানের সঙ্গে দেশে সামরিক শাসন জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। একই সঙ্গে দেশত্যাগের বিষয় নিয়েও কথা বলেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুর রশীদ খানের বইয়ে এ প্রসঙ্গেও বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

এরশাদের সামরিক শাসন জারির পরিকল্পনা সম্পর্কে পরে সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি এই লেখককে বলেছিলেন, এ রকম কোনো প্রচেষ্টা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। সে সময় এতে করে বহু হতাহতের আশঙ্কা ছিল। দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হতো। তবে এ কথা অন্য মন্ত্রীদের কেউ কেউ অস্বীকার করতে পারেননি যে এরশাদের মন্ত্রীদের কেউ কেউ শেষরক্ষার পথ হিসেবে সামরিক শাসন জারির প্রস্তাব করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে এরশাদের বাসভবনে সেনাপ্রধানের কাছে অন্তত একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এ রকম প্রস্তাব সরাসরি করেছিলেন। পরে তিনি এ কথা অস্বীকার করেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে।

এরশাদ প্রেসিডেন্ট অফিসের সামরিক ও বেসামরিক উচ্চ কর্মকর্তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও ৫ ডিসেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে ৬ ডিসেম্বর দুপুরে পদত্যাগের ঘোষণা প্রদানের সময় নির্ধারণ করতে বাধ্য হন। এর আগে ৫ ডিসেম্বর রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত বিরোধীদলীয় নেত্রীদের বক্তৃতা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি তা বন্ধ করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন তত্কালীন তাঁর প্রেস সচিবকে। ৫ ডিসেম্বর দুপুর-বিকেলের এসব তত্পরতা থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এরশাদ তখনো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যথাসম্ভব বিলম্বিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন।

এদিকে ৫ ডিসেম্বর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করা হয় এবং তা সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরশাদের সব ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতার মুখে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বও সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কারণ, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব বা অনৈক্যের অর্থ ছিল এরশাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা।

নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বরও শেষরক্ষার পথ হিসেবে এরশাদ দেশত্যাগের কথাও চিন্তা করেছিলেন। সামরিক সচিব মঞ্জুর রশীদ খানের সঙ্গে এ নিয়ে তিনি কথাও বলেছিলেন। ৫ ডিসেম্বর রাতে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে অনুগতদের সাহায্যে সামরিক শাসন জারি বা অন্য কোনো ভয়ংকর পথ অবলম্বন ব্যর্থ হয়ে গেলে এরশাদের সামনে শেষরক্ষার তেমন কোনো পথ আর তখন খোলা ছিল না।

এটাই সত্য যে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর একই সঙ্গে নানা ষড়যন্ত্র ও ভয়ংকর পরিকল্পনাও ছিল তাঁদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে ও তাঁর সহযোগীদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। কিন্তু সে কথা না মেনে এ কথাই তাঁরা বারবার দেশবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্যই তাঁরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন।

আসলে এরশাদ মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলুন না কেন, সেনাপ্রধান আর সেনাশাসক হিসেবে তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক কার্যক্রম, অপকর্ম আর দুর্নীতিগুলোকে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। তার পরও দুই দশক ধরে এরশাদ দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়ে গেছেন। সেখানেই প্রশ্ন, দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত এবং খুনের মামলার আসামি হয়েও এরশাদ রাষ্ট্রের বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সম্মান লাভ করছেন। দেশবাসীকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দিচ্ছেন। একের পর এক মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। চট্টগ্রামের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর হত্যা মামলার আসামি এরশাদ, সে মামলাও এগোয়নি। এ রকম একজন অপরাধী কি এভাবেই দেশ-বিদেশ ঘুরে সব ষড়যন্ত্র, সব রাজনৈতিক তত্পরতা চালাতে পারেন?

পারেন, কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এরশাদকে মেনে নিয়েছেন, তাঁকে মান্যতা দিয়েছেন। অথচ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ব্যাপারে দেওয়া স্পষ্ট রায়ে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীর শাস্তি নির্ধারণের কথা বলেছেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল না করতে পারে। সপ্তম সংশোধনীর বিষয়ে শুনানির সময়ও রাষ্ট্রপক্ষ এরশাদের বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় বক্তব্য দিয়েছে। তার পরও রাজনৈতিক সমীকরণে এরশাদ এখন অপাঙেক্তয় হয়ে পড়বেন, এমন আশঙ্কা নেই।

আদালত এরশাদের স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এখন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব ইতিহাসে এরশাদের স্থান নির্ধারণের।