সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সৌজন্য বিনিময়’ করবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করবেন নির্বাচন কমিশনাররা। এই সৌজন্য বিনিময়ে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের ঘোষণা আসতে পারে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত চুপচাপ আছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় নিয়ে দোটানায় পড়েছে তারা। নতুন সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের বার্তা পায়নি ইসি। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনাররা নিয়মিত অফিস করছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরদিনই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন।
ইসি সূত্র জানায়, সরকার পতনের পর নির্বাচন কমিশনাররা ধরে নিয়েছেন, তাঁদেরও পদত্যাগ করতে হবে। এ জন্য তাঁরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তবে তাঁরা নিজে থেকে পদত্যাগ করবেন, নাকি এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কোনো চিন্তা আছে, তা বোঝার চেষ্টায় ছিল ইসি। এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তাঁরা রাষ্ট্রপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন; কিন্তু তাতে সফল হননি।
এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ে আসছেন সিইসি ও অন্য কমিশনাররা। নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক মো. শরিফুল আলম জানান, আগামীকাল দুপুর ১২টায় নির্বাচন ভবনের সম্মেলনকক্ষে নির্বাচন কমিশন সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করবে। এই সৌজন্য বিনিময়ে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের ঘোষণা আসতে পারে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের নয়। তবে নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করে যেকোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে বলেও ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র জানায়, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার কথা বলা আছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি সম্ভব নয়, তা পরিষ্কার; কিন্তু সংবিধান স্থগিত করা হয়নি বা সরকার পতনের পরে কোনো ফরমানও জারি করা হয়নি। ফলে নির্বাচন করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়ে গেছে। এই কমিশন যদি আরও এক-দুই মাস দায়িত্বে থাকে, তাহলে এ বিষয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে। কারণ, নির্বাচন আয়োজন করার সাংবিধানিক দায়িত্ব ইসির। আইনি ফাঁকফোকর রেখে যদি নির্বাচন পেছানো হয়, তাহলে কোনো একসময় ইসিকে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। এ ছাড়া যেভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি পুরোপুরি সংবিধান মেনে হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ২৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বিপ্লব ও ফরমান: সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও সফল বিপ্লবোত্তর সাংবিধানিক পরিস্থিতিতে সংকটে রয়েছে।’
সিইসি তাঁর কলামে আরও লিখেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ যখনই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও সরকারের আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে সফল বিপ্লবোত্তর উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি অসামরিক ফরমান জারি করে প্রচলিত সংবিধান স্থগিত বা পাশাপাশি বহাল রেখে অসামরিক ফরমানকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান প্রদান করে সাংবিধানিক বা আইনগত সংকট পরিহার করা প্রয়োজন।’
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর। এর আগের কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশনের মতো হাবিবুল আউয়াল কমিশন নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ছিল। প্রথমবারের মতো একটি আইনের মাধ্যমে এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তবে ২০২২ সালে প্রণয়ন করা ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন’ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
দেশের অন্যতম প্রধান বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ইসিতে নিবন্ধিত বেশির ভাগ দল হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে মেনে নেয়নি। ইসির সংলাপের আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এই কমিশনের আমলে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। শুধু আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র দলগুলো ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া, বিতর্কিত বিভিন্ন সংস্থাকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া, আইনে নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব দেওয়া, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মত পাল্টানোসহ কমিশনের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক ছিল।