৫০ বছরে জাতীয় সংসদ

জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয় পুরো সংসদ ভবন এলাকা। গতকাল রাতে
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

আজ ৭ এপ্রিল। ৫০ বছর আগে ১৯৭৩ সালের এই দিনে বসেছিল জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংসদ গঠিত হয়েছিল।

প্রথম সংসদ গঠনের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের যাত্রা শুরু হয়। তবে বছর দুয়েক পর রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় ফিরে যায় দেশ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর সামরিক শাসনে ব্যাহত হয় গণতন্ত্রের যাত্রা। প্রথমে জিয়াউর রহমান এবং পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশে সামরিক তন্ত্র কায়েম করেন। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে দেশে আবার সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। এর পর থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চলছে। তবে মাঝে ২০০৭ সাল থেকে প্রায় দুই বছর দেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তিতে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। সংসদ হওয়া উচিত দেশের সব মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র।

দেশে তিন দশক ধরে সংসদীয় ব্যবস্থা বহাল থাকলেও জবাবদিহি ও সুশাসন কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। গণতন্ত্রের চর্চা কতটা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

জাতীয় সংসদের ৫০ বছরে সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে ১৭ বার। এসব সংশোধনী নিয়েও বিভিন্ন সময় তর্কবিতর্ক আছে। প্রথম সংসদেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে চারবার। শুধু সপ্তম সংসদে (১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল) কোনো সংশোধনী আনা হয়নি।

প্রথম সংসদে ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয়েছিল। এই সংশোধনী আনা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের জন্য আইন তৈরি করা এবং তা কার্যকর করতে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম সংসদে সংবিধানের এই সংশোধনী এনেছিল।

প্রথম সংসদেই ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, যা বাকশাল নামে পরিচিত। এরপর দুটি সংসদে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানে সংশোধনী আনার মাধ্যমে।

এরশাদের সামরিক শাসনের সময় ‘নির্বাচিত’ সংসদে ১৯৮৮ সালে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিতে পরিবর্তন আনা হয়। তখন সংবিধান সংশোধন করে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। এই সংশোধনীর বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কিন্তু এরশাদের পতনের পর দুই দলই পালাক্রমে সরকার পরিচালনা করলেও রাষ্ট্রধর্মের জায়গায় হাত দেয়নি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবার হত্যার পর যে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল, তার বৈধতা দিতে সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় গঠিত দ্বিতীয় সংসদে এই সংশোধনী আনা হয়। পাশাপাশি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়।

নব্বইয়ের দশকে গণ–আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়। এই ব্যবস্থা চালু করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়।

দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক সরকারের বদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয় ১৯৯৬ সালে। এ জন্য তখন সংসদে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। পরে তা পাল্টে ২০১১ সালে নবম সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে এ পর্যন্ত অনেক আইন পাস হয়েছে। এর মধ্যে এমন অনেক আইন আছে, যেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা–সমালোচনা রয়েছে।

১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস হয়। এই আইন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো আলোচনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর সেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি এড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা দায়মুক্তি জারি করে। খন্দকার মোশতাক আহমদ তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে এই অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৯ সালে সংসদে অধ্যাদেশটিকে আইন হিসেবে পাস করেছিলেন।

২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে জননিরাপত্তা আইন পাস করেছিল। এই আইন নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। পরে সেই আইন বাতিল করা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৮ সালে দশম সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করার পর দেশে–বিদেশে এই আইন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এই আইন সংশোধন বা বাতিলের দাবিতে এখনো আন্দোলন চলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তিতে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। সংসদ হওয়া উচিত দেশের সব মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র।

সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে আজ শুক্রবার বেলা সোয়া তিনটায় জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে স্মারক বক্তৃতা দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন শুরু হয়েছে। তবে গতকাল ছিল সংসদের নিয়মিত কার্যক্রম। আজ রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার মধ্য দিয়েই বিশেষ অধিবেশনের মূল কার্যক্রম শুরু হবে। এই অধিবেশন চলবে আগামী রোববার পর্যন্ত।

দেশের প্রথম জাতীয় সংসদে সংসদ নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে জাতীয় সংসদে সংসদ নেতার আসনে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।