দীর্ঘদিন পর বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম। গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে তাঁকে ঘিরে নানা আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচনে অংশ নেননি তিনি। ভোটের আগেই চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন।
চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে ১১ বছর আগের একটি মামলায় ৫ মার্চ থেকে পাঁচ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। বিএনপির আন্দোলন ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাদির কল্লোল।
স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের জন্য বিএনপির গঠিত কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন আপনি। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ওই কমিটির প্রথম বৈঠক করেছেন। বিএনপির রাজনীতিতে আবার পুরোপুরি সক্রিয় হলেন।
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: দলের নেতৃত্ব আমাকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের এই দায়িত্ব দিয়েছে। এটি আমি পালন করছি। তবে আমার বয়স হয়েছে। ৮০ বছর বয়সে রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় থাকতে পারব, সেটা একটা বিষয়।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মুখেও সরকার নির্বাচন করেছে। এখন বিএনপি যেভাবে এগোচ্ছে, তা আপনি কীভাবে দেখেন?
হাফিজ উদ্দিন: বিএনপিকে এখন নতুন করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের ছক কষতে হবে। কারণ, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির যে আন্দোলন ছিল, সেই আন্দোলনে তো কাজ হয়নি; নির্বাচন হয়েছে। সে জন্য এখন একেবারে নতুনভাবে কৌশল ঠিক করতে হবে। সেটা এককভাবে নয়, দলের অভিজ্ঞ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।
আপনি বলছেন, এককভাবে নয়, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ভবিষ্যৎ করণীয় বা কৌশল ঠিক করতে হবে। এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছেন আপনি?
হাফিজ উদ্দিন: আমি বলছি, নির্বাচনের আগে দীর্ঘ আন্দোলনের বিষয়ে ও বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ সবার মতামত বা সবাই মিলে পর্যালোচনা করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হলে তা দলের জন্য ভালো হবে। সরকার পতনের আন্দোলনে তখন ছক কষে এগোনো সহজ হবে। আগের আন্দোলনে কোনো ভুল হয়েছে কি না, তা–ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমরা ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারলে, তা শুধরিয়ে সামনে এগোলে ভবিষ্যতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। আন্দোলনে বিকল্প উপায় রাখতে হয়। সে জন্য আমি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা বা কৌশল নেওয়ার কথা বলছি।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন ওই নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে আপনাকে ঘিরে নানা আলোচনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত আপনি নির্বাচনে অংশ নেননি। তখন কি কোনো চাপ ছিল, কোনো প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন: আমাকে বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি (নির্বাচনের সময় কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল দল দুটি) দল দুটির যেকোনো একটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করিনি; নির্বাচনেও অংশ নিইনি। নির্বাচনের আগেই আমি সংবাদ সম্মেলন করে আমার এই অবস্থান স্পষ্ট করেছিলাম।
আপনাকে এ ধরনের প্রস্তাব কারা দিয়েছিল। সরকারের কোন পর্যায় থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন: জ্যেষ্ঠ কয়েকজন রাজনীতিক আমাকে এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তাও আমাকে বিএনপি ছেড়ে নতুন দল করে নির্বাচনে অংশ নিতে বলেছিলেন। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে আমার আগের পরিচিত ও কয়েকজন পুরোনো বন্ধুও আছেন।
ভোটের আগে কি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আপনার কোনো কথা হয়েছিল?
হাফিজ উদ্দিন: না। সে রকম কারও সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।
আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নির্বাচন করার কোনো প্রস্তাব কি ছিল?
হাফিজ উদ্দিন: আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার কোনো প্রস্তাব ছিল না। আমাকে ওই নতুন দুটি দলের যেকোনো একটির নেতৃত্ব নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আমি তা করিনি।
রাজনীতিক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা কেন আপনাকে এমন প্রস্তাব দেন?
হাফিজ উদ্দিন: যাঁরা প্রস্তাব দেন, তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, আপনি অনেক দিন ধরে বিএনপিতে স্বস্তিবোধ করছেন না। বিএনপির নেতৃত্ব আপনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এমন ধারণা তাঁদের মধ্যে ছিল। সে কারণেই হয়তো তাঁরা আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বিএনপি যেহেতু আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, ফলে আমি নতুন দল করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারি। এ ছাড়া বিএনপিতেও গুরুত্ব না পাওয়া অনেক নেতা আমাকে এ ধরনের কথা বলেছিলেন। ফলে আমি নির্বাচনে অংশ নিলে আমার সঙ্গে অনেকেই যেতে পারেন—এমন ধারণা থেকেও হয়তো আমাকে ওই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমি প্রস্তাব গ্রহণ করিনি।
শেষ পর্যন্ত আপনি নির্বাচনে অংশ নেননি, সেটি কেন?
হাফিজ উদ্দিন: বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন রয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে আমি রাজনীতি করেছি। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ফলে আমি বিএনপির রাজনীতি ছাড়তে চাইনি। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আমি আমার এলাকার নেতা-কর্মী ও রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আমি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি; কিন্তু নির্বাচন হয়েছে। বিএনপির ওই সিদ্ধান্ত কীভাবে দেখেন?
হাফিজ উদ্দিন: আমি মনে করি, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে মধ্যস্থতা করে, সে ব্যাপারে বিএনপির চেষ্টা করতে হতো; কিন্তু সেটা হয়নি। এ ছাড়া বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করত। এটি আমার ধারণা।
বিএনপি কি তাহলে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে?
হাফিজ উদ্দিন: আমি বলব, বিএনপির আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত ছিল।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হাফিজ উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।