কোটা ও শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে কথা নেই সংসদীয় কমিটিতে

কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক বিষয়গুলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আলোচনায় আসছে না।

জাতীয় সংসদ ভবন
ফাইল ছবি

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি বাতিল চেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতির মতো চলমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনায় আসছে না। একইভাবে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাংক ডাকাতি—সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এসব বিষয় নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোতে।

সংসদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা গবেষকেরা বলছেন, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক বিষয়গুলো সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা না হওয়ার এই প্রবণতা নতুন নয়। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম জাতীয় সংসদ থেকে এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এর মূল কারণ সংসদে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তিশালী ও কার্যকর কোনো বিরোধী দল না থাকা। গত দশম ও একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। চলতি দ্বাদশ সংসদেও যা বজায় রয়েছে।

সরকার ও সংসদের মধ্যে যে একটা পরিষ্কার পার্থক্য আছে, সেটা এখন আর বোঝা যায় না। সংসদে শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
নিজাম উদ্দিন আহমদ, সংসদ বিষয়ে গবেষক

জাতীয় সংসদে মোট ৫০টি সংসদীয় কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি কমিটি মন্ত্রণালয়ভিত্তিক। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটির মূল কাজ হলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা। এর বাইরে সমসাময়িক যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদীয় কমিটি চাইলে আলোচনা করতে পারে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করতে পারে। তবে চলতি সংসদের প্রথম ছয় মাসে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আলোচনা বা অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নিতে কোনো সংসদীয় কমিটিকে দেখা যায়নি।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস ধরেই দেশে আলোচনা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে দেশে থাকা তাঁর সম্পদ (স্থাবর ও অস্থাবর) জব্দ করা হয়েছে। সাবেক এই পুলিশপ্রধানকে নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে গত ২৯ মে বৈঠক করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তবে ওই বৈঠকে বেনজীরের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি।

এই বৈঠকের পর সংসদ সচিবালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, বৈঠকে বিজিবি এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সার্বিক কার্যক্রমের ওপর আলোচনা হয়। ঢাকায় পাসপোর্ট অফিসের সংখ্যা বাড়ানো, কোনো রোহিঙ্গা যেন পাসপোর্ট না পায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং গরু চুরি রোধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

স্বরাষ্ট্রের সংসদীয় কমিটির মতোই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও সমসাময়িক কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি। এই সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয় ২ জুলাই। বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের পাঠানো বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, বৈঠকে বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে বৈঠকে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

এই বৈঠকে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। গত ২১ মে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, তাঁর (আজিজ আহমেদ) কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর জাতীয় সংসদের গত বাজেট অধিবেশনে (জুন মাসে) আজিজ আহমেদ, বেনজীর আহমেদসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন একাধিক সংসদ সদস্য। তবে সংসদীয় কমিটিতে এ–সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি।

স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও চলমান কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয় না। এই সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে ৪ জুলাই। এর আগে ১ জুলাই থেকে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটির সদস্যরা আলোচনা করেননি। একইভাবে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের চলমান কর্মবিরতির বিষয়টিও সংসদীয় কমিটির আলোচনায় আসেনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ৪ জুলাইয়ের বৈঠকে মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করা, কওমি মাদ্রাসাকে মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কার্যক্রম নিয়েও কমিটিতে কথা হয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (সংশোধন) বিল পাসের সুপারিশ করেন কমিটির সদস্যরা। যা বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও উল্লেখ করা হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা থাকা না থাকার বিষয়টি নিয়ে চলমান যে আন্দোলন, তা নিয়ে আলোচনা হয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও। এই কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয় ২ জুলাই।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সভার আলোচ্যসূচি সাধারণত সভার বেশ কিছুদিন আগে নির্ধারণ করা হয়। আলোচ্যসূচির পাশাপাশি পূর্ববর্তী বৈঠকে কমিটির যে সুপারিশগুলো থাকে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর কমিটি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাঁর কমিটির গত বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি ছিল না। এ ছাড়া কমিটির কোনো সদস্যও বিষয়টি আলোচনায় তোলেননি, যে কারণে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। কোনো সদস্য আলোচনায় তুললে এ বিষয়ে আলোচনা হতো বলে মনে করেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক।

গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বান্দরবানে দুটি ব্যাংকে ডাকাতি করে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। এ ঘটনার মধ্যেই ২৫ এপ্রিল পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে গিয়ে বৈঠক করে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু ওই বৈঠকে কেএনএফ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

২৫ এপ্রিল ওই বৈঠকের পর সংসদীয় কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিষয়টি (কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি) বৈঠকের কার্যতালিকায় ছিল না। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখতিয়ার। এখানে অনুমাননির্ভর কোনো সুপারিশ করার সুযোগ নেই। তাই এ নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়নি।

অবশ্য এই সংসদে একটি ব্যতিক্রম দেখা গেছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। ভিসা পাওয়ার পরও বিপুল সংখ্যক কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে না পারার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও সুপারিশ করেছে এই কমিটি। এর বাইরে গত পাঁচ মাসে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটিগুলোর বৈঠকে সমসাময়িক কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়নি।

শুধু বর্তমান সংসদ নয়, এর আগের একাদশ সংসদেও ছিল একই চিত্র। করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক অনিয়মের বিষয় গণমাধ্যমে এসেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ছিল একেবারে চুপ। করোনা–পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট, বাজারদর ও সিন্ডিকেট নিয়েও অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি।

সংসদ বিষয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাজ্যের সংসদীয় কমিটির সঙ্গে দেশের সংসদীয় কমিটির মৌলিক পার্থক্য এই জায়গায়, বাংলাদেশে সংসদীয় কমিটিগুলোতে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনায় আসে না। সরকার ও সংসদের মধ্যে যে একটা পরিষ্কার পার্থক্য আছে, সেটা এখন আর বোঝা যায় না। সংসদে শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় এই পরিস্থিতি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর গঠিত নবম সংসদেও সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনায় আসত। কারণ, তখন বিরোধী দল ছিল। বর্তমান সংসদে যাঁরা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য, তাঁরাও সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। সরকার অখুশি হয়, এমন কোনো বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র সদস্যরাও হয়তো কথা বলতে চান না। সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার আগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে।