উকিল সাত্তারকে ‘ফাঁকা পোস্টে গোল’ দেওয়াতে জোর তৎপরতা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রচার সভায় কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। গত রোববার বিকেলে সরাইল উপজেলার আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া অনেকটা ‘ফাঁকা পোস্টে গোল’ দিতে চলেছেন। শক্তিশালী বিরোধী প্রার্থী না থাকা, স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নানাভাবে চাপে রাখা ও নির্বাচনী প্রচারে তাঁর পক্ষে আওয়ামী লীগ মাঠে নামায় উকিল সাত্তারের জয় অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই পক্ষ থেকেই লাভবান হয়েছেন আবদুস সাত্তার। পাঁচবারের সংসদ সদস্য সাত্তারকে বিজয়ী করতে দ্বন্দ্ব-বিভক্তি সব ভুলে এক হয়ে তাঁর পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কাজ করছেন। অন্যদিকে সরাইলে সাত্তারকে অবাঞ্ছিত ও প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম নেই বিএনপির।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া বিজয়ী হয়েছিলেন। গত ১১ ডিসেম্বর তিনি দলীয় সিদ্ধান্তে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় আসনটি শূন্য হয়। আগামী বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) এ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আজ সোমবার সকালে নির্বাচনের প্রচার শেষ হয়েছে।

৮ জানুয়ারি এই উপনির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর আটজনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। পরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির দুবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধাও।

নির্বাচনী মাঠে আছেন আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (কলার ছড়া), আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ (মোটরগাড়ি), জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানি (লাঙল) ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (গোলাপ ফুল)।

স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উকিল সাত্তারকে বিনা বাধায় জিতিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে। ১৪ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের নেতৃত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এর পর থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আবদুস সাত্তারের পক্ষে একত্র হওয়া শুরু করেন।

প্রচারের বিভিন্ন পর্যায়ে উকিল সাত্তার সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে কর্মিসভা, পরামর্শসভা করা হয়। এসব সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীও সভায় উপস্থিত ছিলেন।

উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল মামুন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সংরক্ষিত সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা আশুগঞ্জে সভা করে এই নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। নির্বাচন যেন নির্বিঘ্নে হয় সে জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামেন। নির্বাচনে দল ও জোটের প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভালো মানুষ বিবেচনায় আবদুস সাত্তারের পক্ষে আছেন। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে সাত্তার সাহেবের পক্ষে কাজ করার কোনো নির্দেশনা নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু করার নির্দেশ আছে।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, সাত্তারকে জেতাতে জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। কলার ছড়া প্রতীকে (আবদুস সাত্তার) ভোট নেওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের। ভোটাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা সাত্তারকে জেতাতে মরিয়া। তাই নির্বাচনের ফল সাত্তারের পক্ষেই যাবে, এটা সবাই বুঝতে পারছেন। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ নেই বললেই চলে।

নির্বাচনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ। তিনি আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। নির্বাচন থেকে আবু আসিফকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবু আসিফের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে থাকা কর্মী-সমর্থকদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানোরও অভিযোগ করা হয়।

এর মধ্যেই আবু আসিফের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গত শুক্রবার রাত থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তাঁরা। তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার কোথাও প্রচারেও দেখা যায়নি আসিফকে। আবু আসিফের ‘নিখোঁজ’ হওয়ায় নির্বাচনে সাত্তারের জয়ের পথ আরও সহজ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা।

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের দাবি, আবু আসিফের নিখোঁজের বিষয়টি বিএনপির অভ্যন্তরীণ ঝামেলা। তিনি বলেন, আবু আসিফের নির্বাচন নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে সমস্যা থাকতে পারে।

নির্বাচনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না

এর আগে গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘নিখোঁজ’ হন আবু আসিফের নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী ও তাঁর শ্যালক শাফায়াত সুমন। এ ছাড়া আবু আসিফের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে ওই দিন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এই আসনের অন্য দুই প্রার্থী জাপার আবদুল হামিদ ভাসানি ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। এলাকায় তাঁদের পরিচিতি কম। নির্বাচনী মাঠেও তাঁরা সেভাবে নামেননি। সাত্তারকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকেও নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা বলছেন।

নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নির্বাচন অনেকটাই উত্তাপহীন। প্রার্থীদের তেমন প্রচারণা ও গণসংযোগ নেই। নির্বাচনী ব্যানার, ফেস্টুন ও প্রচারপত্রও তেমন চোখে পড়ে না। সাধারণ ভোটারদের মতে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই মূলত মাঠে ছোটাছুটি করছেন। ভোট গ্রহণের দিন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় আছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। নির্বাচনে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতিই এখন তাঁদের লক্ষ্য।

২ জানুয়ারি উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সরাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তাঁরা সাত্তারকে প্রতিহত করার ঘোষণাও দেন। পাশাপাশি এই উপনির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ঘোষণা দিলেও মাঠে নেই সরাইল উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। নির্বাচন বর্জনের কোনো প্রচারণাও তাঁরা করছেন না। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে অনেকে এলাকা ছেড়েছেন।

উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিছুল ইসলাম (ঠাকুর) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই নির্বাচন মানি না। এই মুহূর্তে নির্বাচনবিরোধী কোনো প্রচারণাও করছি না, তাঁকে (আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া) প্রতিহত করতেও যাচ্ছি না। তবে বিএনপির কোনো ভোটার তাঁকে ভোট দিতে যাবেন না।’