প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে বেশ কিছু বিষয়ে অগ্রগতি আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে রেলের সংযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং নানা ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তিন বছর বিরতির পর এই সফরকে ‘বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ’ মনে করছে দুই দেশের কূটনৈতিক মহল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সোমবার চার দিনের সফরে দিল্লি আসছেন। আগামীকাল মঙ্গলবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে রেলের আধুনিকায়ন, কুশিয়ারা নদী থেকে পানি প্রত্যাহারসহ অন্তত পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের বৈঠকের পর এসব এমওইউ সই হবে।
জানা গেছে, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে দুই দেশ সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) সইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেপা সইয়ের মাধ্যমে এর সুফল পেতে হলে নানা মাত্রায় সংযুক্তি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের প্রেক্ষাপটে রাজনীতির প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলক্ষে গতকাল রোববার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনিষ্পন্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা অর্জন করা যাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক গভীরতর হওয়াসহ সার্বিকভাবে এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নতুন নতুন উদ্যোগ গৃহীত হবে।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল সকালে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে তাঁরা একান্ত বৈঠক করবেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাতটি প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। এর মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা, উন্নয়ন সহযোগিতা, বাণিজ্য ও সংযুক্তিতে সহযোগিতা, পানিসম্পদে সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও জনগণের মেলবন্ধন এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা এই শিরোনামে আলোচনা হবে।
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী গতকাল সকালে তাঁর দিল্লির বাসায় প্রথম আলোকে বলেন, দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের বাঁক বদলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন, রেলের সংযোগ, যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে নতুন কিছু করা দরকার। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) করা দরকার। এর মাধ্যমে বিনিয়োগ সুরক্ষা ও সেবার বিষয়টা গুরুত্ব পাবে।
দুই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চূড়ান্ত হওয়া এমওইউগুলো হচ্ছে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার, রেলের সক্ষমতা বাড়ানো, বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতা, শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণায় সহযোগিতা এবং দুই দেশের জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতা। এ ছাড়া বাংলাদেশের রেলওয়েকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে সহযোগিতা এবং দুই দেশের মধ্যে মহাকাশবিষয়ক সহযোগিতা নিয়ে এমওইউ সই চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫০ বছরে নানা চড়াই–উতরাইয়ের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক একটা বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপট থেকে সম্পর্কের বর্তমান ধারা যাতে অব্যাহত থাকে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। আবার একইভাবে এই সহযোগিতা যাতে ভারসাম্যমূলক হয়, সেটিও দেখা জরুরি। প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে যাতে পরস্পর লাভবান হয় এবং দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কারণ, সম্পর্ক একমুখী হলে তা টেকসই হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দুপুরে একটি বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। এ সময় তাঁকে স্বাগত জানাবেন ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ। এদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মৌর্য শেরাটন হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। রাতে তাঁর সম্মানে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেবেন।
আগামীকাল রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অব অনারের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানাবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর শেখ হাসিনা রাজঘাটে গান্ধীর সমাধিস্থলে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে হায়দরাবাদ হাউসে। বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদ্বীপ ধানকার এবং পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
৭ সেপ্টেম্বর সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে ব্যবসায়িক ফোরামে অংশ নেবেন। বিকেলে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্টুডেন্ট স্কলারশিপ’ বৃত্তি তুলে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ সেপ্টেম্বর রাজস্থানে যাবেন। তিনি সেখানে আজমির শরিফ দরগায় মাজার জিয়ারত শেষে ওই দিন বিকেলে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লির সফরসঙ্গীদের মধ্যে আছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক।