ভারতে অবস্থানরত বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে ঘিরে ‘রহস্য’ এখনো কাটছে না। আদালতে খালাস পাওয়ার পরও কেন তিনি দেশে ফিরছেন না বা তাঁর ফেরা হচ্ছে না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন ও রহস্যের সৃষ্টি করছে। যদিও ভারতে থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর মহাসচিব হওয়া নিয়েও গুঞ্জন রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত থেকে খালাস পাওয়ার পর সালাহউদ্দিন আহমদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া শুরু করেন। এখন তিনি বিএনপির রাজনীতিতে শুধু সক্রিয় নন, বিদেশে থেকেও দলের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণে তাঁর প্রভাব ছিল। বিশেষ করে গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার চার প্রবেশপথে ‘অবস্থান কর্মসূচির’ সমন্বয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এ নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ছিল। যদিও পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের হামলা, বাধা ও সহিংসতায় অবস্থান কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরের কর্মসূচিগুলোতেও তাঁর নেপথ্য ভূমিকা ছিল বলে জানা গেছে।
অবশ্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের রায়ের পর স্থায়ী কমিটির মিটিংগুলোতে থাকি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে থাকি। সবাই থাকেন। দায়িত্ব দিলে পালন করি, এটুকুই।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নির্বাচনের আগে আন্দোলন-কর্মসূচি সমন্বয়ে বিদেশে অবস্থানরত সালাহউদ্দিন আহমদকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রশ্নে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হয়। বিষয়টি লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকেও আলোচনায় আসে। বিএনপির সঙ্গে এক বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই নেতা ভবিষ্যতে যুগপৎ কর্মসূচি সমন্বয়ে ঢাকায় থাকা বিএনপির কোনো জ্যেষ্ঠ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন। ‘অবস্থান’ কর্মসূচি পণ্ড হওয়ার পর দলের ভেতরে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয় যে দেশে না থেকেও তিনি কীভাবে কর্মসূচি সমন্বয় করবেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ এখনো সালাহউদ্দিন আহমদকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত বা স্বাধীন মনে করেন না। তাঁদের যুক্তি, সালাহউদ্দিন আহমদ আদালতে খালাস পেয়েও দেশে ফিরতে পারছেন না। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর ধরে ভারতে আছেন। সেখানে কতটা প্রভাবমুক্ত থেকে তাঁর পক্ষে শক্ত রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে ‘সংশয়’ আছে। অতি সম্প্রতি সালাহউদ্দিন আহমদকে ঘিরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশে ব্যাপক গুঞ্জন যে তিনি দলের পরবর্তী মহাসচিব হচ্ছেন।
অবশ্য এ ধরনের গুঞ্জন নাকচ করে দিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাসচিব পরিবর্তন হতে গেলে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় সম্মেলন হবে। অথবা দলের চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে পরিবর্তন করেন। এখন মহাসচিবের পদ কি খালি হয়েছে? আমাদের মহাসচিব যথেষ্ট উপযুক্ত লোক। উনি ভালোই চালাচ্ছেন।’
গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা বলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। তাতে একমত প্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিষয়টিতে ঐকমত্য পোষণ করেন বলে সভায় উপস্থিত দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব পদ নিয়ে মাঝেমধ্যেই নানা রকম গুঞ্জন ওঠে। তাতে নেতাদের কেউ কেউ নেপথ্যে থেকে আগ্রহ দেখালেও প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হন না।
সালাহউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, দল মনে করলে মহাসচিব হতেই পারেন, তাঁর যে অবদান। তিনি খুবই উপযুক্ত লোক।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির মতো একটি বড় দলে মহাসচিব হওয়ার মতো যোগ্য অনেক নেতা আছেন। এ জন্য সম্মেলনের প্রশ্ন উঠলে মহাসচিব নিয়ে কথা ওঠে। তবে এই সময়ে মহাসচিব পদে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না।’
২০১৫ সালের শুরুর দিকে এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দিন আহমদ রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন। তখন তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের পদে ছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন দলের মহাসচিবসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় সালাহউদ্দিন আত্মগোপনে থেকে দলের মুখপাত্র হিসেবে বিবৃতি দিতেন, গণমাধ্যমে কথা বলতেন। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন।
বিএনপি তখন অভিযোগ করে, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সালাহউদ্দিন আহমদকে তুলে নিয়ে গেছে। এর ৬২ দিন পর ১১ মে সিলেটের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের মেঘালয়ে শিলংয়ের পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। তখন ভারতের পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সালাহউদ্দিন শিলংয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরি করার সময় লোকজনের ফোন পেয়ে তাঁকে আটক করা হয়। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় সেখানকার পুলিশ। পরে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা এবং পরে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই মামলায় ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর শিলংয়ের নিম্ন আদালত সালাহউদ্দিন আহমদকে খালাস দেন। এর বিরুদ্ধে ভারত সরকার আপিল করে। ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শিলং জজ আদালত সালাহউদ্দিন আহমদকে খালাস দেন।
ভারতে আদালতের রায়ে খালাস পাওয়ার পর ১৫ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো তিনি দেশে ফিরতে পারেননি।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মামলা নেই, আদালত খালাস দিয়েছেন, এর পরেও ফেরত পাঠাচ্ছে না। অনেকে মনে করছে আমি আসছি না। এ নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝি আছে। আপনারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারত সরকারকে জিজ্ঞেস করেন, কেন তারা পাঠাচ্ছে না। আমার তো করার কিছু নেই।’
সালাহউদ্দিন আহমদের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, খালাস পাওয়ার পর আদালতের রায়ের কপিসহ সালাহউদ্দিন আহমদ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে আবেদন করেন। তাঁর পাসপোর্ট না থাকায় এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন তাঁকে একটি ট্রাভেল পাস দেয়। ট্রাভেল পাসের মেয়াদ ৯০ দিন হয়ে থাকে। এ পাস দিয়েই সালাহউদ্দিন আহমদ দিল্লিতে চিকিৎসা করান এবং এর পর তাঁকে মেঘালয়ে যেতে হয়। যেহেতু সালাহউদ্দিন রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং তাঁর মামলাটি রাজনৈতিক, সে জন্য তাঁর বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চায় মেঘালয় রাজ্য সরকার। কিন্তু এখনো এর জবাব আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ট্রাভেল পাস দিয়ে সালাহউদ্দিন ভারতের ইমিগ্রেশন পার হতে পারবেন না। দেশে ফেরার জন্য দুই দেশের প্রত্যাবর্তন আইন অনুযায়ী তাঁর ‘এক্সিট পাস’ প্রয়োজন।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে না। হয়তো ঢাকার সরকার নিষেধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া আর কী হতে পারে।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, আদালতের আদেশে সালাহউদ্দিন আহমদ খালাস পাওয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। চিঠিতে সালাহউদ্দিনকে যত দ্রুত সম্ভব দেশে পাঠানোর সহযোগিতা চাওয়া হয়। তাতেও কার্যকর কিছু হয়নি।
এ ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারকেই ‘সমস্যা’ মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এখন কোনো মামলা নেই। তিনি আদালত থেকে খালাস পেয়ে মুক্ত হয়েছেন। এখন তাঁকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাঠাতে হবে, আর বাংলাদেশ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন আহমদ ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। পরে ১৯৯৬ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে কক্সবাজার থেকে সংসদ সদস্য হন, পরে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পান। শিলংয়ে থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে তিনি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি অসুস্থ, আমার বয়স হয়েছে। দেশে আমার মৃত্যু হোক, এটাই আমার শেষ চাওয়া।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সালাহউদ্দিন আহমদের রহস্যময় নিখোঁজ হওয়া, তাঁর উদ্ধার হওয়ার ঘটনা এবং ভারতে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান বা আটকে পড়ার ঘটনা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ক্ষেত্রে তাঁর দেশে ফেরার পথে আইনগত সমস্যা বা দীর্ঘসূত্রতা রাজনৈতিক কর্মী ও পর্যবেক্ষকদের জন্য আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।