কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বজনদের কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কি না, এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছেন গোয়েন্দারা। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টিও যাচাই করা হচ্ছে। দুটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পৃথকভাবে কাজটি করা হচ্ছে। ইসি সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
তবে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ইসি কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে এই কাজ করার অনুরোধ করেনি। নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর আগে এ ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতায় ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ।
নির্বাচন কমিশন আসলে যে স্বাধীন নয়, এভাবে গোয়েন্দাদের দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা তারই প্রতিফলন। সব জায়গায় নিজেদের লোক রাখতে হবে, এমন চিন্তা থেকেই কাজটি করা হচ্ছে বলে মনে হয়। নির্বাচন কমিশনে যেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন এবং নির্বাচনী কারচুপিতে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কাজটি ইসিকেই করতে হবে।সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার
নাম না প্রকাশের শর্তে ইসি সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন প্রতিনিধি গত মাসের শেষ দিকে ইসি সচিবালয়ে এসে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের ফটোকপি নিয়ে গেছেন। কাছাকাছি সময়ে আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে চান। তখন তাঁর একজন নিকটাত্মীয়র সঙ্গে কথা বলেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ওই কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কি না। বিষয়টি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের জন্য বিব্রতকর।
গত জুলাই মাসে ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় হাওয়া ভবনের মাধ্যমে ইসি সচিবালয়ে বিপুলসংখ্যক দলীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁরা এখন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত রাখতে এ বিষয়ে কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইসি সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব পর্যায়ের কর্মীর তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। গত আগস্ট মাসে এই কাজ শুরু হয়েছে। তাঁরা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে অতীতে যুক্ত ছিলেন কি না, স্বজনদের কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কি না—এসব বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ফোন করে ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়েও জানতে চেয়েছেন।
সাধারণত সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু ইসি সচিবালয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন চাকরি করছেন, তাঁদের সবার বিষয়েই খোঁজখবর করা হচ্ছে। তবে আইন অনুযায়ী, ইসি সচিবালয়ে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা নয়। কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে ইসি অনুরোধ না করার পরও কেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়নি। আইডিইএ (জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য নেওয়া প্রকল্প বা আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস) প্রকল্পে যাঁরা নতুন যোগ দিয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে ভ্যারিফিকেশন (তথ্য যাচাই) করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে ‘গ’ ক্যাটাগরির কেপিআই (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। কেপিআইভুক্ত হলে একটি শর্ত থাকে, যাঁরা এখানে ঢুকবেন, তাঁদের ভ্যারিফিকেশন লাগবে। সেটার আলোকে হয়তো সবার ভ্যারিফিকেশন করা হচ্ছে।
তবে ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবারই প্রথম নয়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও এ ধরনের তৎপরতা ছিল। কমিশনের কর্মকর্তাদের বাইরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য যাঁদের নাম প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল।
ইসি সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের শিক্ষাসনদ, ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন খোঁজখবর করছেন। কোনো কোনো নারী কর্মকর্তার গ্রামের বাড়ির পাশাপাশি শ্বশুরবাড়িতেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও কাজটি করা হয়েছিল।
সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কেও আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এমনকি কমিশন সচিবালয় প্রশাসনিক এবং আর্থিক দিক থেকেও স্বাধীন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের প্রশাসনিক আওতাধীন নয়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) ওপর ন্যস্ত।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা একাধিক সংস্থা বলছে, যেভাবে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে, তা ইসি সচিবালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। ইসি যদি কর্মকর্তাদের বিষয়ে খোঁজখবর করা প্রয়োজন মনে করে, তাহলে তারা নিজেরা সেটা করতে পারে বা সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ করতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন আসলে যে স্বাধীন নয়, এভাবে গোয়েন্দাদের দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা তারই প্রতিফলন। সব জায়গায় নিজেদের লোক রাখতে হবে, এমন চিন্তা থেকেই কাজটি করা হচ্ছে বলে মনে হয়। নির্বাচন কমিশনে যেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন এবং নির্বাচনী কারচুপিতে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কাজটি ইসিকেই করতে হবে।