আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে এক ওয়ার্ডেই ৬টি ক্যাম্প।
সড়ক-ফুটপাতের জায়গায় ক্যাম্প করেছেন স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীও।
মানুষের হাঁটাচলার পথ সংকুচিত করে এক সড়কেই করা হয়েছে তিনটি নির্বাচনী ক্যাম্প। এই তিনটি ক্যাম্প করা হয়েছে মাত্র ৭০ মিটারের মধ্যে। এই চিত্র ঢাকা-৫ সংসদীয় আসনের আওতাধীন ধলপুরের মাদ্রাসা গলিতে। এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই ওয়ার্ডে আচরণবিধি ভেঙে ৬টি অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প (কার্যালয়) করা হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারুনর রশীদের পক্ষে।
আচরণবিধি অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় কোনো ওয়ার্ডে একটির বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। আবার কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সড়ক-ফুটপাতের জায়গা দখল করে নির্বাচনী ক্যাম্প করা যায় না।
ঢাকা-৫ সংসদীয় আসনে শুধু যে নৌকার প্রার্থীই আচরণবিধি ভাঙছেন, এমনটি নয়। এখানে আওয়ামী লীগের দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁরাও নির্বাচনী ক্যাম্প করার ক্ষেত্রে আচরণবিধি মানছেন না। সড়ক-ফুটপাতের জায়গায় স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা (ট্রাক প্রতীক) ও কামরুল হাসানের (ঈগল প্রতীক) নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডেই মশিউরের নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে ৫টি। কামরুলের নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে ৩টি।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মোটরসাইকেলে করে ঢাকা-৫ সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪টি ওয়ার্ড নিয়ে এই আসন গঠিত। ওয়ার্ডগুলো হলো ৪৮, ৪৯, ৫০, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৩, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯ ও ৭০। এই আসনের ভোটার প্রায় ৫ লাখ। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম। তিনি এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি, নির্বাচনে প্রার্থীও হননি।
গতকাল বেলা ১১টায় ধলপুর নতুন রাস্তা থেকে মাদ্রাসা গলির মুখে ঢুকতেই চোখে পড়ে পরপর তিনটি নির্বাচনী ক্যাম্প। বাঁশ-কাঠ ও কাপড় দিয়ে মূল সড়কের ওপর স্থাপন করা প্রথম ক্যাম্পটি নৌকার। এই ক্যাম্পের ভেতরে টেবিল ও চেয়ারও বিছানো। তবে কোনো নেতা-কর্মীর দেখা পাওয়া যায়নি। এই ক্যাম্প থেকে ৪০ মিটার সামনে এগোলেই ঈগল প্রতীকের নির্বাচনী ক্যাম্প। এর ৩০ মিটার দূরে ট্রাক প্রতীকের ক্যাম্প করা হয়েছে।
এই আসনে ১০টি রাজনৈতিক দলের মোট ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর বাইরে দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন, যাঁরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। নৌকার প্রার্থী হারুনর রশীদ (মুন্না) যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বাবা এই আসনের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল হাসান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, এখানে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
ধলপুর এলাকার বাসিন্দা সায়মন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনজনই শক্ত প্রার্থী। কে জিতবেন, তা বলা মুশকিল।
ধলপুর মাদ্রাসা গলি থেকে ধলপুর কমিউনিটি সেন্টার ও গোলাপবাগ মাঠের দূরত্ব ১০০ মিটারের মতো। ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের মূল ফটকের সামনে ফুটপাতে একটি এবং রাস্তার ওপর আরেকটি ক্যাম্প করা হয়েছে ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী মশিউর রহমানের পক্ষে। ধলপুর কমিউনিটি সেন্টার থেকে ধলপুর ওয়াসার রোড ২০০ মিটার দূরে। সেখানেও ট্রাকের পক্ষে আরেকটি ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। ওয়াসা রোড থেকে ৩০০ মিটার দূরে পূর্ব গোলাপবাগেও তাঁর নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে। পুরো এলাকা একটি ওয়ার্ডের আওতাধীন। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, এই এলাকায় ক্যাম্প থাকার কথা একটি।
আচরণবিধি ভঙ্গ করে নির্বাচনী ক্যাম্প করার বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
মশিউরের মতোই আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল হাসানের পক্ষে পূর্ব গোলাপবাগে সড়কের ওপর একটি নির্বাচনী ক্যাম্প এবং গোলাপবাগ খেলার মাঠে মানুষের হাঁটাচলার জায়গায় আরেকটি ক্যাম্প করা হয়েছে। ক্যাম্প রয়েছে মাদ্রাসা গলিতেও।
আচরণবিধি ভঙ্গ করে ফুটপাত ও সড়কে নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল হাসান দাবি করেন, ফুটপাতে তাঁর কোনো ক্যাম্প নেই।
মানুষের হাঁটাচলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে মোট ৬টি নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে নৌকার প্রার্থী হারুনর রশীদের পক্ষে। এর মধ্যে পূর্ব গোলাপবাগে সড়কের ওপর একটি, গোলাপবাগ খেলার মাঠে মানুষের চলাচলের জায়গায় দুটি, ওয়াসা রোডে দুটি, মাদ্রাসা রোডে একটি এবং ধলপুর নতুন রাস্তার ফুটপাতে আরেকটি ক্যাম্প রয়েছে।
নৌকার প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এত ক্যাম্প করার অনুমতি দিইনি। এরপরও যদি কেউ করে থাকে, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের মতোই ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডেও একাধিক নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে নৌকার প্রার্থীর। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী পার্কের ভেতরে মানুষের হাঁটার জায়গায়, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী নতুন রাস্তার ওপর এবং যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের ফুটপাতে নৌকা প্রতীকের একটি করে নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে।
আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মাইকিং করার নির্দেশনা থাকলেও ঢাকা-৫ আসনে তা মানা হচ্ছে না। গতকাল বেলা পৌনে ১২টার সময় এই প্রতিবেদক ছিলেন গোলাপবাগ খালের মাঠের পূর্ব পাশের সড়কে। সেখানে তখন রিকশায় করে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে মাইকিং করা হচ্ছিল। দুপুর ১২টার সময় ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে ভোট চেয়ে থেকে মাইকিং করতে দেখা যায়। গোলাপবাগ খালের মাঠ ও ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের দূরত্ব ৬০ মিটারের মতো। এই দুই জায়গার মাঝখানে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে। এই ক্যাম্প থেকে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মাইকে ভোটের গান বাজানো হয়।
আচরণবিধি ভঙ্গ করে এই আসনের কদমতলীতে মূল সড়কের ওপর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এই আসনের বিভিন্ন জায়গায় নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে রঙিন পোস্টার লাগানো হয়েছে।
এই তিন প্রার্থী বাদে অন্য প্রার্থীদের ব্যানার-পোস্টার তেমন চোখে পড়েনি। এই আসনের অন্য প্রার্থীরা হলেন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের আবু জাফর মো. হাবিব উল্লাহ (চেয়ার), বিএনএফের এস এম লিটন (টেলিভিশন), তৃণমূল বিএনপির আবু হানিফ (সোনালী আঁশ), ইসলামী ঐক্যজোটের আব্দুল কাইয়ূম (মিনার), এনপিপির আরিফুর রহমান (আম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের নূরুল আমিন (ছড়ি), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মোশারফ হোসেন মিয়া (একতারা), বাংলাদেশ কংগ্রেসের সাইফুল আলম (ডাব), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সারোয়ার খান (কাঁঠাল)।
আচরণবিধি ভঙ্গ করে নৌকা, ট্রাক ও ঈগল প্রতীকের তিন প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প করা এবং মাইকিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম না মানার বিষয়ে জানতে প্রথম আলো কথা বলেছে ঢাকা-৫ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা বীথি দেবনাথের সঙ্গে। গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে তিনি বলেন, ফুটপাতে নির্বাচনী ক্যাম্প করার তথ্য তাঁকে কেউ জানায়নি। ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়গুলো দেখবেন।