গত রোববার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
গত রোববার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়া

সংস্কার প্রশ্নে একমত, নির্বাচন নিয়ে রূপরেখা চায় কেউ কেউ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। তারা রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার প্রশ্নে একমত হলেও কোনো কোনো দল ওই ভাষণে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ বা রূপরেখা না থাকার বিষয়টি তুলেছে।

দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি বলেছে, এই ভাষণে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে তারা। তবে নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা সংস্কারের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এ সরকারকে সময় দেওয়ার কথা বলছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার দুই সপ্তাহের বেশি সময় পর গত রোববার জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি।

মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সেটি হলে তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সে ব্যাপারে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর তাঁদেরই এ আলোচনা শুরু করতে হবে। কারণ, তাঁরা সরকারে রয়েছেন।

‘নির্বাচনের বিষয় অস্পষ্ট’

জাতীয় সংসদ নিবাচন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।’ তাঁর এই বক্তব্যে নির্বাচনের বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে বলে মনে করছে বিএনপি।

সরকার গঠনের বেশ কয়েক দিন পর প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তাতে বিএনপি প্রাথমিকভাবে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। আমরা আশা করেছিলাম যে তিনি নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো রোডম্যাপ দেবেন; কিন্তু ভাষণে তা নেই।’

গতকাল সোমবার মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সেটি হলে তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সে ব্যাপারে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর তাঁদেরই এ আলোচনা শুরু করতে হবে। কারণ, তাঁরা সরকারে রয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। গতকাল ঢাকায় এক কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকার এখনো রাইট ডিরেকশনে (সঠিক পথে) আছে।’

বিএনপির মিত্র দল ও জোটগুলোর মধ্যে অন্যতম গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকার বিষয়টিকে তুলে ধরেন। মঞ্চের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ আশা করেছিলেন তাঁরা। তবে তিনি উল্লেখ করেন, দেশে স্থিতিশীলতা আনা, ছাত্র আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কাজ এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তার প্রতিফলন আছে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে।

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। গতকাল ঢাকায় এক কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকার এখনো রাইট ডিরেকশনে (সঠিক পথে) আছে।’

তবে ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ ইতিবাচক; কিন্তু দলগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু না বলায় নানামুখী সংশয়-সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।

বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও (সিপিবি) রোডম্যাপের প্রত্যাশা ছিল। তবে সেটি নির্বাচনের সময় নিয়ে নয়। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে রোডম্যাপ প্রয়োজন ছিল।

জাতীয় পার্টি অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এ মুহূর্তে নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে চায় না। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সার্বিকভাবে সংস্কারের যে কথা উঠে এসেছে, সেটিকে তাঁরা স্বাগত জানান।

সংস্কারে একমত

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্যপ্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।’

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনে ভেঙে পড়া সব খাতেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে সব রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, নির্বাচনের আগে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দু–তিন বছর সময় দেওয়া যেতে পারে।

তবে সংস্কার চাইলেও এ জন্য কতটা সময় দেবে, সে ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট নয়। বিএনপি ‘যৌক্তিক’ সময় দেওয়ার কথা বলছে। দলটি সংস্কার নিয়েও সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা চাইছে। দলটির নেতা মির্জা ফখরুল বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তাঁদের দলের ৩১ দফা প্রস্তাব রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও সংস্কারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ফলে আলোচনায় বসলে তাঁদের ৩১ দফা ও সরকারের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি আশা করেন, সরকার দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনার উদ্যোগ নেবে। মির্জা ফখরুল এ-ও বলেন, বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া যেন না হয়, সে ব্যাপারেও সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।

এদিকে ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে আছেন। সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফলে দলটির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।