আজ ভোট গ্রহণ। ৫৭ জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৯২, সদস্য পদে ১,৪৮৫ ও সংরক্ষিত পদে ৬০৩ জন প্রার্থী।
চেয়ারম্যান পদে ২৬ জন, সাধারণ সদস্য পদে ৬৫ জন ও সংরক্ষিত পদে ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।
ভোলা ও ফেনীতে সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় সেখানে ভোট হচ্ছে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালীর নির্বাচন আদালতের নির্দেশে স্থগিত।
দেশের ৫৭টি জেলা পরিষদে আজ সোমবার সকাল নয়টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ২৬টিতেই চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বাকি চেয়ারম্যান ও সদস্য পদগুলোতে যাঁরা প্রার্থী, তাঁদের বড় অংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা সমর্থিত প্রার্থী।
ভোটাররা হলেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। যাঁদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের। এ রকম একটা ভোট নিয়েও উত্তেজনা, অস্থিরতা, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের ওপর হামলা ও হুমকির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে বরিশাল জেলা পরিষদের ৩২ জন ভোটারকে স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনার জন্য ডেকে মাইক্রোবাসে করে কুয়াকাটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জেলা পরিষদ নির্বাচন একটি অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
দেশে দ্বিতীয়বারের মতো এই নির্বাচন হচ্ছে। এবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় উত্তেজনা তৈরি হয়। কোনো কোনো এলাকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ভোটের মাঠে সক্রিয় হন বলে অভিযোগ ওঠে।
এই নির্বাচনে ভোট নেওয়া হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সব কটি ভোটকেন্দ্রে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। ইসি কেন্দ্রীয়ভাবে সিসিটিভির মাধ্যমে ভোট পর্যবেক্ষণ করছে। ইসি যাতে সরাসরি ভোট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে না পারে, সে জন্য কোথাও কোথাও ভোট গ্রহণের সময় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা–পরিকল্পনা হচ্ছে বলে খবর পেয়েছে ইসি। এ কারণে ভোটের সময় উপজেলা সদরগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখার অনুরোধ জানিয়ে গতকাল বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিতরণ সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়েছে ইসি। ইসি জানিয়েছে, ২৬ জেলায় চেয়ারম্যান পদে ছাড়াও নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদে ১৮ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলা পরিষদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদ নির্বাচন আদালতের নির্দেশে স্থগিত করা হয়েছে। ভোলা ও ফেনী জেলা পরিষদের সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এই দুই জেলায় ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না।
ইসি জানায়, আজকের নির্বাচনে ৫৭টি জেলার চেয়ারম্যান পদে মোট প্রার্থী ৯২ জন, সাধারণ সদস্য পদে ১ হাজার ৪৮৫ জন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদে ৬০৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৫৭টি জেলায় মোট ভোটার ৬০ হাজার ৮৬৬ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৬২টি এবং ভোটকক্ষ ৯২৫টি। সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে।
জেলা পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় প্রতীকে হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত আওয়ামী লীগ এবং দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের পোলিং এজেন্ট রেখে ভোটারদের প্রভাবিত করার আশঙ্কা করছেন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী কে এম বজলুল হক খান। নির্বাচন চলাকালে স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ–সংযোগ, ইন্টারনেট ও সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এসব আশঙ্কার কথা তিনি গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানান। তাতে তিনি বলেন, যেহেতু ভোটার সংখ্যা খুবই কম, তাই সামান্য সময়ের জন্য বিদ্যুৎ না থাকলেও ভোটকেন্দ্রগুলো নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সরকারদলীয় প্রার্থী খুব সহজেই কারচুপি করবেন।
অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম মহীউদ্দীনের দাবি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যেসব অভিযোগ বা আশঙ্কা করছেন, এর কোনো সত্যতা নেই। এটা তাঁর নির্বাচনী কৌশল।
নির্বাচন চলাকালে ভোটকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক আবদুর রশিদ মৃধা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুল আলম। গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে এ শঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তবে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কোনো প্রভাব বিস্তার হবে না।
শেরপুরে জেলা পরিষদ নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী মো. হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে কালোটাকা ও সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী চন্দন কুমার পাল। তবে হুমায়ুন কবীর দাবি করেন, পরাজয় আঁচ করতে পেরে চন্দন পাল বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ করছেন।
জেলা পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় প্রতীকে হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত আওয়ামী লীগ এবং দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে
বরিশাল জেলা পরিষদের ৩২ জন ভোটারকে স্থানীয় একটি খাবার হোটেলে আলোচনার জন্য ডেকে মাইক্রোবাসে করে কুয়াকাটায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও বরিশাল জেলা পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার।
সদস্য পদপ্রার্থী মাইনুল হোসেন ওরফে পারভেজ মৃধা অভিযোগ করেছেন, আরেক সদস্য পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আকন এই জনপ্রতিনিধিদের কৌশলে কুয়াকাটা নিয়ে গেছেন। ভোটের দিন সকালে কুয়াকাটা থেকে নিয়ে এসে সরাসরি তাঁদের পক্ষে ভোট দেওয়ানোর জন্য এই কৌশল নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে কাকে কুয়াকাটায় নিয়ে গেছেন, সেটা আমার জানা নেই। আর যাঁরা গেছেন, তাঁরা তো যেতেই পারেন। এটা তাঁদের ব্যাপার।’
তবে বরিশালের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা জসীম উদ্দীন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মৌখিকভাবে অভিযোগটি পেয়েছেন। কুয়াকাটা তাঁর আওতার বাইরে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনার ও ডিআইজিকে অবহিত করেছেন।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার সদস্য পদপ্রার্থী খান শাহীন সাজ্জাদের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শাহীন সাজ্জাদের অভিযোগ, গত শনিবার রাত ১০টার দিকে তিনি ও তাঁর সমর্থক সালামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহমেদ কালিয়া পৌরসভার সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তাঁদের দুজনের গাড়ি ভাঙচুর করেন প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য প্রার্থীর সমর্থকেরা।
বরগুনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া এক সাধারণ সদস্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচার থেকে ফেরার পথে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটারদের গুলি করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়া রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, শেরপুর, যশোরসহ কয়েকটি জেলায় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ‘জেলা পরিষদ নির্বাচন একটি অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষায় ‘জেলা পরিষদ একটি অথর্ব, অকার্যকর প্রতিষ্ঠান।’ এটি এখন একটি আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে গেছে। তবে এখানে একটি আকর্ষণ আছে।
সেটা হলো জেলা পরিষদের অনেক সম্পদ আছে। ভাতা, সম্মানীসহ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নানাভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
যে কারণে এই নির্বাচনেও ২৬ জন চেয়ারম্যানসহ অনেক সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যেখানে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানেও ভোট কেনাবেচার অভিযোগ এবং নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা।)