জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বিরোধের নেপথ্যে

রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদের
ফাইল ছবি

মনোনয়ন নিয়ে এখনো জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মধ্যকার বিরোধ মেটেনি। গতকালও রওশন ও তাঁর ছেলে সাদ এরশাদ দলীয় মনোনয়ন ফরম নেননি। রওশন তাঁর ছেলেসহ কয়েকজন অনুসারীর জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু আসনে মনোনয়ন চান। তাতে সম্মত নন জি এম কাদের। এ নিয়ে দুই পক্ষই অনড় অবস্থান নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আপাতদৃষ্টে দুই নেতার এই বিরোধ মনোনয়নকেন্দ্রিক মনে হলেও কার্যত এটি জাপায় দুই পক্ষের ‘নিয়ন্ত্রণ’ ও ‘কর্তৃত্ব’ নিরঙ্কুশ করার শেষ চেষ্টা। কারণ, এত দিন দুই নেতার বিরোধ ছিল নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্নে। রওশন শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে, আর জি এম কাদের অনেকটা বিপক্ষেই ছিলেন। এখন দুজনই নির্বাচনের পক্ষে।

এরই মধ্যে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে জাপা ২৮৯টি আসনে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করে প্রার্থীদের নামের তালিকাও প্রকাশ করেছে। যদিও রওশন এরশাদের ময়মনসিংহ-৪ সদর আসনসহ ১২টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি।

জাপার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জি এম কাদেরের অমত ছিল। এ নিয়ে শেষ দিকে এসে সরকারের দিক থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের চাপ আসে। শেষ পর্যন্ত মোটাদাগে দুটি শর্তে জি এম কাদের নির্বাচনে যেতে সম্মত হন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। একটি হলো নির্বাচনে জয়ী হলে দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। এ ছাড়া তাঁর সিদ্ধান্তে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে। এতে কারও হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবার আমরাই তো ম্যাডামকে (রওশন এরশাদ) বিরোধীদলীয় নেতা, জি এম কাদেরকে উপনেতা বানিয়েছিলাম। এখন ওনার এই দায়িত্ব পালন করার মতো শারীরিক অবস্থা নেই। আমরা মনে করি, আবার নির্বাচিত হয়ে এলে স্বাভাবিকভাবে চেয়ারম্যানেরই বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার কথা।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মূলত এই শক্ত অবস্থানের লক্ষ্য দুটি। এর মধ্য দিয়ে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদের মাধ্যমে যাতে কেউ কোনো ধরনের সুবিধা নিতে না পারেন—সেটি বন্ধ করা। এসব বিষয়ে গত রোববার রাতে রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় জি এম কাদেরসহ একটি বৈঠক হয়। সেখানে সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তাও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। যদিও গতকাল পর্যন্ত দুই নেতার বিরোধের সুরাহা হয়নি।

ওই সূত্র জানায়, রওশন তাঁর ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ ওরফে সাদ ছাড়া আরও পাঁচজন অনুসারীকে পছন্দসই আসনে মনোনয়ন দিতে চান। তাঁরা হলেন জাপার সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা), দলের ময়মনসিংহ জেলার সাবেক সভাপতি কে আর ইসলাম, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনূর রশিদ ও হাবিবুল্লাহ বেলালী এবং যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন। কিন্তু সাদ এরশাদ ও কে আর ইসলাম ছাড়া অন্যদের মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত নন জি এম কাদের।

রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, দলীয় মনোনয়নের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় তাঁর অনুসারীদের বৈঠক হয়। বৈঠকে রওশন, সাদ এরশাদ, মসিউর রহমান, রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশিদ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে গোলাম মসীহ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের প্রায় ১০০ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন। তাঁদের যদি মূল্যায়ন করা না হয়, তাহলে রওশন এরশাদ নির্বাচনে যাবেন না। আর মসিউর রহমান বলেছেন, তিনি নির্বাচনী এলাকা রংপুরের গঙ্গাচড়ায় যাচ্ছেন। জনগণ চাইলে তিনি সেখান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন।

জানা গেছে, রওশন এরশাদের মনোনয়ন ও তাঁর নির্বাচনী আসন নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। মূলত জটিলতা সাদকে নিয়ে। কারণ, সাদ রংপুর-৩ আসনে নির্বাচন করতে অনড়। অন্যদিকে সাদকে ভাই প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আসনটি কোনোভাবেই ছেড়ে দিতে রাজি নন জি এম কাদের। তা ছাড়া এই আসন থেকে তিনি একবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এটাকে জাপার সবচেয়ে জনসমর্থনপূর্ণ আসন মনে করা হয়। এই আসনের বিকল্প সাদকে ময়মনসিংহ-৭ আসন প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে জাপার নেতা আবদুল হান্নান সংসদ সদস্য ছিলেন।

সাদ এরশাদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘জি এম কাদের তাঁর আসন কিডন্যাপ (অপহরণ) করেছেন। আমি আব্বুর (এরশাদ) সিট ছাড়ব না।’

অবশ্য জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের গোঁ ধরলে তো মুশকিল। চেয়ারম্যানও (জি এম কাদের) তো এরশাদের ভাই। এই আসনে তিনি আগে এমপি ছিলেন।’

জাপার দায়িত্বশীল নেতারা জানান, এখনো সময় আছে। তাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রওশন এরশাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন। এর পরেও না এলে কিছুই করার থাকবে না।