জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ৭ জানুয়ারি ‘সঠিক’ নির্বাচন হয়নি। এটি সরকারের ইচ্ছানুযায়ী একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন ছিল। এই সরকারকে কেউ বিশ্বাস করবে না, সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যেটা ছিল, সেটাও থাকবে না।
ভোটের পরদিন আজ সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন জি এম কাদের।
জি এম কাদের গতকাল রোববার ভোটের পর নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। ভোট চলাকালে দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সব সময় আমাদের আশঙ্কা ছিল যে নির্বাচনে নিয়ে এসে আমাদের কোরবানি করা হবে। কোরবানি করে নির্ভেজাল, একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হবে। এসব আশঙ্কা সত্যি হয় কি না, তা বিকেল হলেই বোঝা যাবে।’
ভোটের পর প্রতিক্রিয়া না জানালেও আজ সকালে রংপুরে জি এম কাদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনি দু–তিন দিন পরে ঢাকায় ফিরবেন। তখন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।
মুঠোফোনে জি এম কাদের বলেন, সরকারের ইচ্ছানুযায়ী কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে তারা ঢালাওভাবে অনিয়ম করতে পেরেছে। কোনো কোনো জায়গায় নির্ধারণ করা ছিল, কাকে পাস করানো হবে। অর্থাৎ, নির্বাচনটা সরকার নিয়ন্ত্রণ করেছে। আগে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, এটাও সে রকম।
জি এম কাদের বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম, সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, নির্বাচন আগের মতো হবে না। কেন্দ্র জবরদখল হবে না, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে, সেটা পাইনি।’
জাতীয় পার্টি এবারের নির্বাচনে ১১টি আসনে জয় পেয়েছে। বর্তমান সংসদে তাদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন ২৩ জন। এর ফলে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা কমে অর্ধেকের নিচে নামল। ওদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন ৬২ জন। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা।
সব মিলিয়ে বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বতন্ত্ররা জোট করে বিরোধী দল হতে পারে, এমন সুযোগ আইনে রয়েছে। এর ফলে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানও হারাতে পারে।
সংসদে বিরোধী দল কে হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, ‘সেটা আমি জানি না। তবে আইন অনুয়ায়ী যা হওয়ার, তা–ই হওয়া উচিত। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একটি বড় অংশ জয়ী হয়েছে। এরপর আমরা (জাপা) আছি। স্বতন্ত্ররা তো দলীয় না। স্বতন্ত্র দিয়ে তো কোনো বিরোধী দল হয় না, তাঁদের দলে যোগ দিতে হবে।’
জি এম কাদের বলেন, ‘৫টি হোক ১০টি হোক, নৌকার বিপক্ষে এখন পর্যন্ত লাঙ্গল আছে, এ পর্যন্তই জানি। আমরা সংসদে যেতে চেয়েছি, যে কয়টা হোক পেয়েছি। তবে নির্বাচন ভালো হয়নি। এখন আমরা বসব পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।’
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির জন্য ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়। সেখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিল না। এ বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘আমি একটি কথা বারবার বলছি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কোনো জোট হয়নি, সমঝোতা হয়নি। আমরা তাদের কাছে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছিলাম। দলীয়করণের কারণে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একপক্ষ হয়ে গেছে, সেটা যাতে নিরপেক্ষ হয়, জোর করে কেন্দ্র দখল হবে না, আমাদের প্রার্থীরা যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। কিন্তু তা হয়নি।’
জি এম কাদের বলেন, ‘যে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ নৌকার প্রার্থী দেয়নি, সেটা তাদের পছন্দে হয়েছে। এই তালিকার অনেকে আমাদের দল থেকে বহিষ্কৃত। রংপুর ছাড়া দুই-এক জায়গায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সেটা সরকারের ইচ্ছানুযায়ী। বাকিগুলোতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ছাড় দেওয়া হয়নি।’
জি এম কাদের মনে করেন, ২৬ আসনে সমঝোতার কথা বলে অন্যান্য জায়গায় তাঁদের প্রার্থীদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের দিন ২৬ আসনের বাইরের অন্তত ২০ জন প্রার্থী আমাকে ফোন করে বলেছেন যে জোর করে কেন্দ্র দখল করা হচ্ছে, তাঁদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ করলেও পোলিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, এমনকি রিটার্নিং অফিসার উল্টো অনিয়মকারীদের “এন্টারটেইন” করেছে।’
‘আমার বিশ্বাস, নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না’
এদিকে রংপুরে নিজের পৈতৃক নিবাসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জি এম কাদের বলেন, ‘সার্বিকভাবে নির্বাচন ভালো হয়নি। যেটি আশঙ্কা করেছিলাম, সেটিই হয়েছে। সরকার যেখানে যাকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই হয়েছে। যার জন্য নির্বাচনে কেউই আসতে চাচ্ছে না। আমার বিশ্বাস, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।’
জি এম কাদের আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা নতুন ধরনের ডাইমেনশন (মাত্রা) দেখা গেল। এটার জন্য ভবিষ্যতে সরকারকে মাশুল দিতে হবে বলে আমার বিশ্বাস।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করে এসছিলাম, তারা সেটা রক্ষা করেনি।’
ভোটে অনিয়ম নিয়ে রংপুরেও কথা বলেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগের রাত থেকে আমরা অনেক জায়গা থেকে খবর পাচ্ছিলাম, সেখানে আমাদের প্রার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সারা দিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে কমপ্লেইন (অভিযোগ) এসেছে। একই কথা ১০টা, ১১টা, ১২টার মধ্যে তারা সমস্ত কেন্দ্রগুলো দখল করে ফেলেছে।
তারা আমাদের এজেন্টদের বের কেরে দিয়ে তাদের এজেন্টদের দিয়ে সিল মারিয়ে নিচ্ছে, যেখানে প্রিসাইডিং অফিসাররা আমাদের মানুষদের সমর্থন করেননি। প্রশাসন সম্পুর্ণ তাদের কাজ করেছে, যেটা আমরা সব সময় আশঙ্কা করেছিলাম।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া ভুল কি শুদ্ধ, এটা এখনই মূল্যায়ন করা যাবে না। সামনের দিনগুলো দেখতে হবে। এরপর আমরা বিষয়টি বুঝতে পারব।’