সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এই আন্দোলন চলছে। মাঠের কর্মসূচির পাশাপাশি চলছে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন। মূলধারার ছাত্রসংগঠনগুলো কোটার বিষয়ে সরাসরি মাঠে নামেনি। তাহলে এই আন্দোলন নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর তৎপরতা কী বা তারা আসলে কী ভাবছে?
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা বলেন, তাঁরা কোটার বিষয়ে একটি যৌক্তিক সমাধান চান। তবে ঠিক কেমন সমাধান তাঁরা চান, সেটি স্পষ্ট করে বলেননি।
বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে সরকার আবার নিজেদের স্বার্থে কোটা ফিরিয়ে আনছে।
অন্যদিকে পুরোপুরি বাতিল না করে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে মত বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠনের।
ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে কোটার বিষয়ে মাঠে নামেনি। যদিও কয়েক দিন ধরে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মধুর ক্যানটিনে জমায়েত হচ্ছেন। যাঁরা চলমান কোটা আন্দোলনে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন, তাঁদের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন বা ছিলেন। ছাত্রলীগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে বাধা দিচ্ছে না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সংগঠনটির কিছু নেতা-কর্মী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কোটাব্যবস্থা ও চলমান আন্দোলনের বিষয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান কী, তা জানতে চাওয়া হলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইনি পথেই কোটার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে বলে তাঁরা মনে করেন। কোটাব্যবস্থার বিষয়টি যেহেতু বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, তাই সংশ্লিষ্ট সব বিষয় মাথায় রেখেই একটি যৌক্তিক, ইতিবাচক পদ্ধতি বের করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে মেধার বিষয়টি যেমন আছে, একই সঙ্গে অনগ্রসরদের প্রতি ছাত্রলীগের দায়বদ্ধতার দিকটিও আছে। দুটি বিষয়ের যুগপৎ সমন্বয় ঘটিয়ে একটি স্থায়ী সমাধান তৈরি হওয়া প্রয়োজন। এটি যেহেতু একটি নীতিগত বিষয়, তাই ‘মব জাস্টিসের’ মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করার কোনো বিষয় নেই। আলাপ-আলোচনা, বিচারিক প্রক্রিয়া ও নীতিনির্ধারণের পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান করা সম্ভব।
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, কোটার বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকেই হাইকোর্টের রায়ের বিপরীতে আপিল করা হয়েছে। সব পক্ষকে তাঁরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আহ্বান জানান। কারণ, তাঁরা সবাই একটি যৌক্তিক সমাধান চান। শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা এবং ইতিবাচক, শান্তিপূর্ণ ও গুণগত উপায়ে বিষয়টির সমাধানের চেষ্টা করা, ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন না করার ব্যাপারে সবার প্রতি তাঁরা আহ্বান জানাচ্ছেন। সহনশীলভাবে বিষয়টির সমাধানের জন্য তাঁরা চেষ্টা করছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ব্যবহার করার জন্য যে রাজনৈতিক পক্ষগুলো সব সময় তৎপর থাকে, শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে যারা নিজেদের ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি বাস্তবায়ন করতে চায়, সেই ফাঁদে যেন কেউ পা না দেয়, শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে সচেতন থাকবে বলে তাঁরা আশা করেন।
ছাত্রদলের দায়িত্বশীল নেতারা চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ মোড়কেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলোয় ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কিছু নেতা-কর্মীকে নিয়মিতই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। তবে কর্মসূচিতে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ চাইলে সেই সুযোগ তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না বলে অন্তত দুজন নেতা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় কোটাব্যবস্থা রাখা অযৌক্তিক বলে মনে করেন তাঁরা। তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য অতি সীমিতসংখ্যক কোটা রাখা যেতে পারে। ২০১৮ সালে সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো কোটাব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি উষ্মা থেকে এমন দুরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যাতে পরবর্তী সময়ে আবার আদালতকে ব্যবহার করে কোটা পুনর্বহাল করা যায়।
নাছির উদ্দীন আরও বলেন, সরকার একদিকে নিজেদের দলীয় লোকদের ভুয়া সনদ দিচ্ছে, আবার সেই সনদ দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। আদালতকে ব্যবহার করে সরকার আবার নিজেদের স্বার্থে কোটা ফিরিয়ে আনছে। দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোটাব্যবস্থা বাতিল করতে কোনো আইনগত বাধা নেই। বর্তমানে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন চলছে, তা সম্পূর্ণ যৌক্তিক বলে বিবেচনা করে ছাত্রদল সংহতি প্রকাশ করছে। যেকোনো প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ছাত্রদল।
বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের লড়াকু অবস্থান’ বলে উল্লেখ করে এর প্রতি একাত্মতা জানিয়েছে। গতকাল রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে এক সংবাদ সম্মেলনে জোটভুক্ত সংগঠনগুলোর নেতারা এই একাত্মতা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, শাসকদের সংকীর্ণ স্বার্থ ও বৈষম্যমূলক নীতির কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সামাজিক সাম্য তৈরির বদলে বৈষম্যের প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কোটা বাতিল কোনোভাবেই সমাধান নয়। প্রয়োজন কোটার যৌক্তিক সংস্কার। ‘বৈষম্যমূলক’ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল এবং অনুন্নত জনপদ, অনগ্রসর জাতিসত্তা ও বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের জন্য যৌক্তিক মাত্রায় কোটা নিশ্চিত করার দাবি জানান বাম ছাত্রনেতারা।
এই জোটের বাইরে থাকা ছাত্র ইউনিয়নের অন্য অংশের নেতারাও কোটাব্যবস্থার সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। ৪ জুলাই সংগঠনটির এই অংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা ও সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ এক বিবৃতিতে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের জন্য কতখানি কোটা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন, তা নিয়ে অবশ্যই স্থায়ী সমাধান আসা উচিত। পাশাপাশি কোটাপদ্ধতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধীদের গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা প্রত্যাশা করেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে সরকার অবিলম্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে কোটাপদ্ধতির সংস্কার সাধনের মাধ্যমে চলমান সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত করবে।
কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে রাজনৈতিক পরিচয়হীন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে আছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতারা।
নানা অভিযোগ তুলে গত বছরের জুলাইয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন ২১ নেতা। তাঁদের উদ্যোগেই ১০ মাস আগে গঠিত হয় ছাত্রশক্তি।
ছাত্রশক্তি ছাড়াও গণসংহতি আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশন ও এবি পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্রপক্ষের নেতারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। ছাত্র অধিকার পরিষদেরও কেউ কেউ এই আন্দোলনে সক্রিয়।