বিএনপি আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে চায়

দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা বলছেন, তাঁরা চলমান আন্দোলনের একটা শেষ দেখতে চান। কারণ, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে।

সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে চায় বিএনপি। এতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও যুক্ত করার বিশেষ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে চূড়ান্ত আন্দোলন একটি গণবিস্ফোরণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এমন চিন্তা থেকেই সব বিভাগ ঘুরে এসে আবারও ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন ইউনিয়নে পদযাত্রার পর জেলা ও মহানগরে এ কর্মসূচি দেওয়া হবে। এরপর রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে ‘লংমার্চ’ বা ‘ঘেরাও’-এর মতো কর্মসূচি আসতে পারে। যেখান থেকে সরকার হটানোর এক দফার আন্দোলন শুরু হবে। তবে এই কর্মসূচি কখন হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি।

দলটির নীতি-কৌশল নির্ধারণে ভূমিকা রাখেন, এমন একাধিক নেতা বলছেন, তাঁরা চলমান আন্দোলনের একটা শেষ দেখতে চান। কারণ, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। হাতে সময়ও আর বেশি নেই। সামনে রোজা। এরপর দুটি ঈদ। তারপর বৃষ্টিবাদলের মৌসুম আছে। এগুলো শেষ হতে হতেই সময় হয়ে যাবে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার। অন্যদিকে বিএনপি গত বছরের জুলাই মাস থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে আছে। ছয় মাস ধরে টানা কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ক্লান্তি ধরছে। এ পরিস্থিতিতে আরও ছয় মাস কর্মসূচি টেনে নেওয়া কঠিন হবে। যদিও তৃণমূল থেকে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে যেতে একরকম তাগিদও আছে। কিন্তু কবে থেকে, কীভাবে এর শুরু হবে, সে ধরনের পরিকল্পনা বা ছক এখনো হয়নি।

বিএনপির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তাদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো মাঠে আরও আস্থা জাগাতে পারলে এটি আরও বাড়বে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই নামবে। কারণ, বিদ্যুৎ-গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের মধ্যে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ফলে আস্থাশীল নেতৃত্ব পেলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। সেটাকে লক্ষ্য ধরে বিএনপি চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনে শহর থেকে একেবারে গ্রামের মানুষকেও যুক্ত করার চেষ্টা করছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মুহূর্তে দলের নীতিনির্ধারকেরা কিছুটা চিন্তিত ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি নিয়ে। কারণ, বিএনপি এই কর্মসূচি ঘোষণার দুই দিন পর হঠাৎ গতকাল বুধবার সরকারি দল আওয়ামী লীগও একই দিনে সারা দেশের সব ইউনিয়নে ‘শান্তি সমাবেশ’ কর্মসূচি দিয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে এক সমাবেশে বিএনপি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে একই দিনে দুই কর্মসূচি ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মাঠ পর্যায়ে সংঘাত সৃষ্টি হয় কি না, সে আশঙ্কা করছেন নেতারা।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সংঘাত এড়িয়ে চলছি। আমাদের সমস্ত কর্মসূচি অহিংস। কিন্তু ওরা যা কিছু করছে, সব উসকানিমূলক। এই যে শান্তি সমাবেশের নামে যে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে, এটা পুরোপুরি সন্ত্রাসের উসকানি। আমরা চেষ্টা করছি সেটা ওভারকাম করতে। এরপরও যদি বাধে (সংঘাত), এর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ সরকারের।’

বিএনপি গত জুলাই মাস থেকে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে এবং সরকারি দলের হামলায় এ পর্যন্ত ১৭ জন নেতা-কর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে গত বছরের ৩০ জুলাই থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৯ হাজার ১১৩ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৫৪২টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় আরও ৭৮ হাজার ৮১২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ৫৫৫ জন নেতা-কর্মীকে।

বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, সামনের কর্মসূচিগুলোতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মাঠে নামবেন। যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হয়। দলের নেতারা বলছেন, সরকারি দল ও পুলিশ প্রশাসন বিরোধী দলের কর্মসূচিতে হামলা করে, মামলা দিয়ে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এ কারণে সাধারণ মানুষ বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমর্থন করলেও ভয়ে রাস্তায় নামছে না। এই ভীতির পরিবেশ কাটিয়ে তুলতে জ্যেষ্ঠ নেতারা রাস্তায় নামবেন। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও কীভাবে এ আন্দোলনে শামিল করা যায়, সেটিও ভাবা হচ্ছে। এখন ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন এবং পরবর্তী সময়ে জেলা পর্যায়ে পদযাত্রার কর্মসূচিকে বড় আন্দোলন গড়ার ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়নে ইউনিয়নে পদযাত্রা যুগপৎ আন্দোলনের ষষ্ঠ কর্মসূচি। বিএনপির পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এলডিপি, গণফোরাম, পিপলস পার্টিও পদযাত্রা করবে।

এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে তৃণমূল থেকে জনগণের সম্পৃক্ততা চাই। আগে একবার তৃণমূলে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ঢাকা শহর পর্যন্ত (বিভাগীয় সমাবেশ) এসেছি। আবার আমরা তৃণমূলে কর্মসূচি শুরু করেছি। আমাদের বিশ্বাস, এই আন্দোলনের বাতাস অতি দ্রুত ঢাকা শহরে পাওয়া যাবে।’

দলের নেতারা মনে করছেন, এখনই বড় আন্দোলন গড়ে তোলার উপযুক্ত সময়। দেশ মারাত্মকভাবে আর্থিক সংকটে পড়েছে। বিদেশি ঋণ বেড়ে গেছে, দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাত প্রায় ধ্বংসের কিনারে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতও ধ্বংসের মুখোমুখি। নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, সামনে আরও বাড়বে। জনসম্পৃক্ত এ বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে তৃণমূল থেকে আন্দোলন সংগঠিত করতে চায় বিএনপি। যাতে মানুষ বোঝে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী, কারা এই সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয় না। দেশে গণতন্ত্র নেই, ভোটের অধিকার নেই, মানবাধিকার নেই—এগুলোর সঙ্গে জাতির অস্তিত্ব জড়িত। আমরা বিশ্বাস করি, এই আন্দোলনে সব মানুষকে একত্র করে বড় রকমের জনতার একটা চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হব। জনতার এই চাপের মধ্য দিয়ে সরকার বাধ্য হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে।’