‘শান্তিপূর্ণ’ থেকে সংঘর্ষের দিকে রাজনীতি

বিএনপির নেতা–কর্মীদের পুলিশের ধাওয়া। শনিবার মাতুয়াইলে
ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের কঠোর অবস্থান লক্ষণীয় ছিল। অন্তত পাঁচটি জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। অন্যদিকে ‘সতর্ক পাহারার’ নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে কোনো কোনো জায়গায় সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের ভূমিকায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সরকার শক্তি প্রয়োগের দিকে যাচ্ছে।

লাখো মানুষের জমায়েতে ঢাকায় মহাসমাবেশ করার পরদিনই বিএনপি গতকাল শনিবার রাজধানীর চারটি প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু বিএনপির ঘোষিত জায়গাগুলোতে অবস্থান কর্মসূচিতে দলটির নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ সেভাবে ছিল না। তারা বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি পুলিশের বাধা ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সতর্ক পাহারার মুখে।

বিএনপি বেলা ১১টা থেকে পাঁচ ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিলে তাঁরা কোনো কোনো জায়গায় আধা ঘণ্টা এবং কোনো জায়গায় ঘণ্টাখানেক সময় থাকতে পেরেছেন। মাতুয়াইল এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। মাতুয়াইল ও ধোলাইখাল এলাকায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছে।

ধোলাইখাল এলাকায় সংঘর্ষের সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং গাবতলীতে দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতা আমানউল্লাহ আমানসহ অনেকে আহত হয়েছেন। এই ঘটনাগুলো বিএনপির পক্ষে যাবে বলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে। কিন্তু মহাসমাবেশে বড় জমায়েত করার পরদিনই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। এমন পরিস্থিতি নেতা-কর্মীদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এই আলোচনাও দলটির কারও কারও মধ্যে রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখন ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিনই ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি রাখার পরিকল্পনা করেছেন। সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে রাজপথ-রেলপথ অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও, নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি বিবেচনায় রেখেছেন তাঁরা।

বিএনপি এখন একটি দিনও কর্মসূচির বাইরে রাখতে চায় না। সে জন্য তারা শনিবার পবিত্র আশুরার ছুটির দিনেও অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু শনিবারের কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনার পর রোববার বিরতি দিয়ে সোমবার মহানগরগুলোতে ও জেলায় জেলায় জনসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। শনিবার রাতে এই কর্মসূচি ঘোষণার সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু রোববার বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে, সে জন্য তাঁরা একই দিনে কর্মসূচি দিচ্ছেন না। কারণ, তাঁরা সংঘাত এড়াতে চান।

ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীদের অবস্থান। শনিবার নয়াবাজারে

তবে শনিবার বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়াও রাজধানীতে ছয়টি যাত্রীবাহী বাস আগুন দিয়ে পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার জন্য বিএনপি ও ক্ষমতাসীনেরা পরস্পরকে দায়ী করেছেন। কিন্তু বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, গত ডিসেম্বর থেকে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও পদযাত্রার মতো কর্মসূচি পালন করে আসছেন। শনিবারের অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে সংঘাতের ঘটনায় সরকার আবার বিএনপির বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগ আনার সুযোগ নেবে। আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে সরকারের ফাঁদে পা দেওয়া হলো কি না—এমন প্রশ্নেও আলোচনা রয়েছে দলটির ভেতরে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য মনে করে, তাদের অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে সরকারের ব্যাপারেই নেতিবাচক ধারণা হবে। এতে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

এত দিন ধরে বিএনপির সমাবেশ বা পদযাত্রাসহ কর্মসূচিগুলোতে সরকার সেভাবে বাধা দেয়নি; বরং অনেক কর্মসূচির ব্যাপারে পুলিশের নিরাপত্তাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শনিবারের অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশকে কঠোর অবস্থানে দেখা যায়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হতেই পুলিশ তাঁদের ওপর চড়াও হয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে লক্ষ্য করে কর্মসূচির দিকে যাচ্ছে বিএনপি। এ ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে কঠোর হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও এখন কঠোর অবস্থানে থেকে বিরোধীদের কর্মসূচি প্রতিরোধ করবে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীন দলের ওই দুই নেতার বক্তব্যের প্রতিফলন পাওয়া গেছে শনিবার বিকেলে দলটির সংবাদ সম্মেলনেও। এই সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পরিষ্কার বলতে চাই, বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস আবার শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চুপ করে থাকতে পারেন না। আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করব। নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকব। অগ্নিসন্ত্রাস প্রতিরোধ করব।’

পুলিশের অবস্থান। শনিবার মাতুয়াইলে

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বেশি নেই। ফলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধ থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ বিপরীতমুখী কঠোর অবস্থান এখন সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

তবে আলোচনা বা সংলাপের ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অটল বিএনপি। অন্যদিকে বিএনপির দাবি কিছুতেই মানা হবে না—এমন অনড় অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

দুই পক্ষই নিজ অবস্থানের ‘জয়’ চায় রাজপথে। এমন মনোভাব সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেল শনিবার বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় বের করা উচিত দুই পক্ষকে। তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে না হাঁটলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের শঙ্কা কাজ করছে।