আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে ‘সাবালক’ জাতীয় পার্টি

আসন সমঝোতা ছাড়া জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রাখা যাবে না—এই বার্তা পেয়ে সমঝোতার পথেই হাঁটছেন ক্ষমতাসীনেরা।

জাতীয় পার্টি (জাপা) নিজেকে এখন ‘সাবালক’ মনে করছে। আওয়ামী লীগেরও প্রত্যাশা, ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের তকমা পাওয়া জাপাকে এবার ‘সত্যিকারের’ বিরোধী দল হিসেবে দেখা। তবে আসন সমঝোতা ছাড়া জাপাকে নির্বাচনে রাখা যাবে না—এই বার্তা পেয়ে সমঝোতার পথেই হাঁটছেন ক্ষমতাসীনেরা।

যদিও জাপার নেতারা এবার আসন নিয়ে কোনো দর-কষাকষিতে না যাওয়ার কথাই বলছেন, কিন্তু দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রায় সবাই সংসদ সদস্য হতে চান। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া তা কতটা সম্ভব—সেই সন্দেহ রয়েছে জাপায়।

সে জন্য দলটির নেতারা বক্তব্য-বিবৃতিতে যা-ই বলুন না কেন, দলটি আওয়ামী লীগের দিকেই তাকিয়ে আছে। জাপার শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। ফলে সমঝোতা ছাড়া জাপাকে নির্বাচনে রাখা যাবে না—এমন বার্তাও ক্ষমতাসীনদের দিয়েছেন তাঁরা।

জাপা এবার সাবালক হয়েছে। আমরা এবার জোটফুট নিয়ে ভাবছি না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।
মুজিবুল হক, মহাসচিব, জাতীয় পার্টি

জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের এবারের সমঝোতা কীভাবে হবে—এটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এরই মধ্যে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হকের (চুন্নু) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাপার নেতা এ কে এম সেলিম ওসমানের আসনে আগে থেকেই প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ জাপা নেতাদের আসনে দলীয় প্রার্থীর বাদ পড়াকে সমঝোতার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, এমনিতেই জাপার শীর্ষ নেতাদের আসনে আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল’ প্রার্থী দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, জাপার সঙ্গে সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পর্যায়ে এখনো আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হয়নি। নির্বাচনে জাপাকে অংশ নেওয়ার বিষয়ে রাজি করানো, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ মেটানো এবং দলটির চাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের হয়ে কয়েকটি পক্ষ ভেতরে-ভেতরে কাজ করেছে। এখনো ওই পক্ষগুলো জাপার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।

আজ সোমবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষ হচ্ছে আজ। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর আগে জাপার সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যায়ে আপস-রফার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, জাপার নেতারা ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তবে আনুষ্ঠানিক সমঝোতার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।

গতকাল রোববার জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাপা এবার সাবালক হয়েছে।’ কোন অর্থে সাবালক হয়েছে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাইলে গত রাতে তিনি বলেন, ‘আমরা এবার জোটফুট নিয়ে ভাবছি না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। সারা দেশে প্রার্থী দিয়েছি। এটাকেই সাবালক বলছি।’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে তিনি জানান।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, জাপা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতর কিছুটা অস্বস্তিও আছে। দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে এবার যে গড়িমসি করেছে, তাতে আওয়ামী লীগ মনে করছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। এ জন্য আওয়ামী লীগ অন্যান্য পক্ষের মাধ্যমে জাপাকে যুক্ত রাখছে।

২০০৬ সাল থেকেই জাপা আওয়ামী লীগের মিত্র। ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে জাপা আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিয়েছে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে জাপার নেতারা মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। তখন থেকেই ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের তকমা জোটে দলটির।

জাতীয় পার্টির ব্যাপারে গতকাল আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে জাতীয় পার্টি কোনো তালিকা পাঠায়নি। সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি নিজেদের প্রমাণ করার মোক্ষম সময় এটি।

দুই পক্ষই সুবিধাজনক জায়গায় ভাবছে

বর্তমান সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা ২৩। দলটি মনে করছে, বিএনপিবিহীন ভোটে জাপার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনের পর সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে। তাই তাদের দাবি ৬০টি আসন, ৪০টি ছাড়া চলবেই না।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, জাপা গত দেড় দশকে সংসদে থেকেও জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিক শক্তি কোনোটাই বাড়াতে পারেনি। দলটি মূলত নেতানির্ভর হয়ে পড়ছে। নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। এ ছাড়া জাপা প্রকাশ্যে বলছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। ফলে বেশি আসনে ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

এ ছাড়া ঢাকা বাদে বাইরের যেসব আসনে জাপা গত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, এর বেশির ভাগই হয় বিএনপি-অধ্যুষিত নতুবা আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থী নেই। সব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ১০-১৫টি আসনে একধরনের সমঝোতা হতে পারে।

বিএনপির ভোটে নজর দেওয়ার তাগিদ

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, সত্যিকারের বিরোধী দল হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে জাপা এবার ভোট করলে দীর্ঘ মেয়াদে দলটির লাভ হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সারা দেশে ভোটে আছেন। এ সুযোগে আওয়ামী লীগবিরোধী এবং বিএনপির কিছু ভোট জাপার বাক্সে যাবে। এটা করা গেলে জাপার আসন না বাড়লেও তাদের ভোট বাড়বে।

জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, একা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে জাপার এবার কোনো দুর্বলতা নেই। নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে তাঁরা চিন্তিত নন। তিনি বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট আমরা পাব। তখন আওয়ামী লীগের চেয়ে আমাদের আসন বেশি হবে।’

কিন্তু জাপার অন্য একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জাপার যে নেতারা সহজেই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হতে চান, তাঁরাই সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছেন।