আসন ভাগাভাগি নিয়ে জাপায় দিনভর ‘নাটক’

জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টি

কয়েক দিন ধরেই আসন ভাগাভাগির তৎপরতার পাশাপাশি শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনেও ছিল নাটকীয়তা। অবশেষে দিনভর নাটকীয়তার পর নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দেয় জাপা।

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় বিকেল চারটার আধা ঘণ্টা আগে বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক বলেন, ‘আমরা ২৮৩ আসনে নির্বাচন করব।’

যদিও গতকাল সকাল থেকেই বনানীতে জাপার চেয়ারম্যানের কার্যালয় ঘিরে একধরনের উত্তেজনা ছিল। নেতা-কর্মীদের একটি অংশ ‘দালালি নয়, রাজপথ রাজপথ’, ‘নির্বাচন নয়, বর্জন বর্জন’সহ নানা স্লোগানে বিক্ষোভ করে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য কার্যালয় ঘিরে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে তাঁরা কার্যালয়ের ভেতরে, জাপার চেয়ারম্যানের কক্ষে গিয়ে বসেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন ভূমিকায় উপস্থিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়ায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসতে পারে।

জাপার একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দিনভর বনানীর কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভসহ যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়, সেটি ছিল মূলত দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরের জন্য ঢাকা-১৮ আসনটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।

পরে জানা যায়, জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে ঢাকার চারটি আসনে ছাড় দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তা না করা হলে জাপা নির্বাচনে যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের পক্ষ থেকে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

জাপার একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দিনভর বনানীর কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভসহ যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়, সেটি ছিল মূলত দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরের জন্য ঢাকা-১৮ আসনটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কারণ, আওয়ামী লীগ ঢাকায় একটি আসনও কাউকে ছাড়তে রাজি ছিল না। অবশেষে সরকারি মহলের মধ্যস্থতায় শেরীফা কাদেরের আসনটি ছাড় দিতে সম্মত হয় আওয়ামী লীগ। এর পরেই জাপার নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা আসে। কিছুক্ষণ পর দলটির বনানীর কার্যালয়ের সামনে শেরীফা কাদেরের নামে এক দল কর্মীকে আনন্দমিছিল করতেও দেখা যায়।

বাদ পড়লেন চার নেতা

তবে এত নাটকীয়তা ও ধূম্রজালের পর জাপা নির্বাচনে গেলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় দলটির নীতিনির্ধারণী কয়েকজন নেতা বাদ পড়েছেন। আবার যেসব আসন জাপা চায়নি, সেসব আসনও দেওয়া হয়েছে। ফলে এই সমঝোতা নিয়ে নেতাদের অনেকে ক্ষুব্ধ। এর মধ্যে দলের কো–চেয়ারম্যান ও বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন ও প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন সমঝোতা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। আরেক কো–চেয়ারম্যান সালমা ইসলামও বাদ পড়েছেন।

কাজী ফিরোজ রশীদ (ঢাকা-৬) থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল যেটা ভালো মনে করেছে, সেটা করেছে। আর আমি যেটা ভালো মনে করেছি, সেটা করেছি। আমি আগেই বলেছি, নৌকা থাকলে নির্বাচন করব না। কারণ, ২০ বছরের মিত্রের সঙ্গে ভোটের মাঠে সম্পর্ক ভাগাভাগি হোক চাই না।’

তবে সৈয়দ আবু হোসেন ঢাকা-৪ ও লিয়াকত হোসেন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে নৌকা প্রতীকের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সৈয়দ আবু হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি দলের ভেতরের একটি চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। জাতীয় পার্টিতে আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে শুরু থেকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য পক্ষে ছিলাম। অথচ আমার সঙ্গে এ কাজটি করা হলো।’ আর লিয়াকত হোসেন তাঁকে অবমূল্যায়ন করার অভিযোগ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেটা হয়েছে, সেটা দলের জন্য ভালো হয়নি।

কারণ, আওয়ামী লীগ ঢাকায় একটি আসনও কাউকে ছাড়তে রাজি ছিল না। অবশেষে সরকারি মহলের মধ্যস্থতায় শেরীফা কাদেরের আসনটি ছাড় দিতে সম্মত হয় আওয়ামী লীগ।

এক আসনের জন্য নাটকীয়তা?

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কত আসনে তাঁদের ‘সমঝোতা’ হয়েছে, জাপার পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘কিছু কিছু আসনে আমাদের (জাতীয় পার্টির) যাঁরা সিনিয়র নেতা আছেন, (আওয়ামী লীগের) যারা নির্বাচন করে, তাদের সঙ্গে হয়তোবা একটা সমঝোতা হয়েছে বা হবে। তবে আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি, এটাই বড় কথা।’

যদিও বনানীতে যখন জাপার মহাসচিব সংবাদ সম্মেলন করছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে যায় দলের সভাপতির চিঠি নিয়ে। চিঠিতে ‘আওয়ামী লীগ জোটভুক্ত প্রার্থী থাকার কারণে’ ২৫টি আসনে (প্রার্থীর নাম ও আসন উল্লেখ করে) দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করার কথা জানায়। এই আসনগুলো জাতীয় পার্টির নেতাদের।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপার সঙ্গে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হয়। এর মধ্যে গতকাল আওয়ামী লীগ ২৫টি আসনে প্রার্থী প্রত্যাহারের চিঠি পাঠায়। এর আগে আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি, আসনটি ফাঁকা রেখেছিল। সেখানে সেলিম ওসমান জাপার প্রার্থী। ফলে এই আসনটিও জাপার ভাগে পড়েছে।

জানা গেছে, রুহুল আমিন হাওলাদারের আসনটিও সমঝোতা তালিকায় ছিল না। শেষ মুহূর্তে দেশের ভেতরে ও বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী মহলের তৎপরতায় তিনি পটুয়াখালী-১ আসনটি পান।

দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আসন সমঝোতার বিষয়ে গত শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত গুলশানে জাপার জ্যেষ্ঠ কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বাসায় বৈঠক হয়। জি এম কাদেরসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বৈঠকে ছিলেন। একপর্যায়ে বৈঠক থেকে বের হয়ে জি এম কাদের দেশের ভেতরে ও বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। আবার বৈঠকে ফেরার পর সবাই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে ২৬ আসন থেকে আরও অন্তত পাঁচটি না বাড়ালে তাঁরা নির্বাচন বর্জন করবেন। সকাল পর্যন্ত এই অবস্থানে থেকেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এখন মনে হচ্ছে ঢাকার একটি আসনের জন্যই এত নাটক করা হয়েছে।

জানা গেছে, রুহুল আমিন হাওলাদারের আসনটিও সমঝোতা তালিকায় ছিল না। শেষ মুহূর্তে দেশের ভেতরে ও বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী মহলের তৎপরতায় তিনি পটুয়াখালী-১ আসনটি পান। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে জাপার প্রার্থী হিসেবে মো. আবদুল হামিদের নাম উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনে তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করার চিঠি দেয়। কিন্তু জাপা আবদুল হামিদকে প্রার্থী করেনি। গত রাতে সেখানে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে জি এম কাদের বনানীর কার্যালয়ে পৌঁছান। এর কিছু সময় পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় তাঁর কক্ষে যান। এর কিছু সময় পর থেকে দ্বিতীয় তলায় ঢোকার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেটি বিকেলে খোলা হয়।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, গতকাল সকালে জি এম কাদের যখন বনানীর কার্যালয়ে ঢুকছিলেন, তখন গণমাধ্যমকর্মীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। এ সময় জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক তাঁকে একটু দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। তখন জি এম কাদের বলেন, ‘ঢাকাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। ভিক্ষার সিট আমি নেব না।’ এ কথা বলে তিনি তাঁর কক্ষে চলে যান।

ঢাকার কোনো আসন তখন পর্যন্ত সমঝোতায় ছাড়তে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ। পরে ঢাকা-১৮ আসনটি ছাড় পাওয়ার পর জাপার মহাসচিব ঘোষণা করেন, ‘আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি।’