আঘাত আরও আসবে, তা জানিয়ে দেশবাসীকে সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘যখন আমার আব্বা দেশটাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তো ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে।
উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার চেতনায় জয় বাংলা ফিরে এসেছে। এগুলো যারা সহ্য করতে পারবে না, তারা বসে থাকবে না। তারা আঘাত করবে। বাংলাদেশকে আবারও জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করবে। সে বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাব।’
গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। আজ রোববার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ সভা হয় সকাল সাড়ে ১০টায়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েক শ নেতা-কর্মী। আজ ওই ভয়াবহ হামলার ১৮তম বার্ষিকী।
বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকারকে চাপ দিচ্ছে—এমন ইঙ্গিত করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন তাদের সঙ্গে বসতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের খাতির করতে হবে। তাদের ইলেকশনে আনতে হবে। এত আহ্লাদ কেন, আমি তো বুঝি না।
বাংলাদেশে কি আর মানুষ নেই? বিদেশিদের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে। সেখানে থেকে এসে রিকোয়েস্ট করে, কোনোমতে তাদের একটু জায়গা দেওয়া যায় কি না? জায়গা দেবে কি না, সেটা ভাববে জনগণ। সে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ। তারা আবার সেই সন্ত্রাসের যুগে ফেরত যাবে, নাকি আজকে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেই উন্নয়নের যুগে থাকবে, এ সিদ্ধান্ত তো জনগণকে নিতে হবে।’
আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। কেউ যদি ইলেকশন করে; ইলেকশন করবে কীভাবে? যে দলের নেতাই নেই, সাজাপ্রাপ্ত অথবা পলাতক, তারা ইলেকশন করবে কী, আর কীভাবে ভোট পাবে? ভোট কাকে দেখে দেবে—এটাই তো প্রশ্ন। তারপরও অনেক চক্রান্ত আছে। এখনো যেমন নানা রকমের চক্রান্ত। ইলেকশন সামনে এলেই শুরু হয়। কিন্তু এ দেশের মানুষের ওপর আমার আস্থা আছে। বিশ্বাস আছে।’
আজ ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ২১ আগস্ট নিহত নেতা–কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। বক্তৃতার সময় তিনি কয়েকবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছে, প্রত্যেকেই কিন্তু কষ্ট ভোগ করছে। যত বয়স বাড়ছে, ততই তাদের শরীরের যন্ত্রণা বাড়ছে। আমি সকলের খোঁজ রাখি। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে তাদের সাহায্য করি। আমার যতদূর সাধ্য, করে দিয়েছে। আমি কাউকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি। কাউকে জমি কিনেছি। ঘর করে দিয়েছি। মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়েছ। প্রতি মাসে ওষুধ কেনার টাকা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তারা যা হারিয়েছে, সেটা তো ফেরত দিতে পারব না। তাদের শরীরের যন্ত্রণা তো প্রশমন করতে পারব না।’
আওয়ামী লীগ প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না—এমনটি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই যে কষ্টগুলো নিয়ে মানুষ বেঁচে আছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বারবার আঘাতের শিকার হচ্ছে, কিন্তু আমরা সরকারে এসে তো রিভেঞ্জ (প্রতিশোধ) নিতে যাইনি। আমরা তো ওদের ঘরবাড়ি দখল করতে যাইনি। হাতুড়ি দিয়েও পিটিয়ে মারিনি। কারাগারেও রাখিনি। কিছুই করিনি।’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বক্তৃতাগুলো অনুসরণ করবেন। কোটালীপাড়া বোমা পুঁতে রাখার আগে বলেছিল, আওয়ামী লীগ শত বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে—শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধী দলের নেতাও কোনো দিন হতে পারবে না। এগুলোর তো রেকর্ড আছে।
এই বক্তৃতা আগাম দিল কীভাবে যে বিরোধী দলের নেতা হতে পারব না। তার মানে আমাকে হত্যা করবে—এ পরিকল্পনা তারা নিয়ে ফেলেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ–জাতীয় হত্যাকাণ্ড হতে পারে না। লক্ষ্য তো ছিল আমাকে হত্যা করা, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া চেষ্টা করেছিল। এরপর একাত্তরে চেষ্টা করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান চেষ্টা করেছিল। আজকে গুম–খুন নিয়ে কথা বলে। আমি তো মনে করি, আমাদের আওয়ামী লীগের যত নেতা-কর্মী আছে, ওই জিয়ার আমলে যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর যাদের হত্যা করা হয়েছিল, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আসা দরকার যে তারা কী করেছিল।’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরে সংসদে আওয়ামী লীগকে তৎকালীন বিএনপি সরকার কথা বলতে দেয়নি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়া সেখানে বলে দিল, ওনাকে আবার কে মারতে যাবে? উনি তো নিজেই গ্রেনেড নিয়ে গেছেন! নিজেই গ্রেনেড হামলা করেছেন! মানে আমি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। এটাই হচ্ছে তাদের কথা।’
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি আজ সমস্যায় জর্জরিত; সেই সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা। আজকে সারা বিশ্বের মানুষ, প্রতিটি দেশ, সেই আমেরিকা বলেন ইংল্যান্ড বলেন, ইউরোপ বলেন—সব জায়গায় জ্বালানি তেলের অভাব। এসব জায়গায় বিদ্যুতের অভাব, খাদ্যের অভাব, খাদ্যের উচ্চমূল্য।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি একেকটি দেশে ১০ থেকে শুরু করে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী যেখানে মন্দা, বিশ্বব্যাপী যেখানে পণ্যের উচ্চমূল্য, আমরা তো এর থেকে বাইরে যেতে পারি না। সেই ধাক্কা আমাদের ওপর এসেও লাগছে। এ জন্য আমি বহু আগে থেকে বলে আসছি, এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখবেন না। প্রতিটি যুদ্ধের পর কিন্তু দুর্ভিক্ষ হয়। কাজেই আমাদের দেশে যেন কখনো খাদ্যঘাটতি না হয়, সে জন্য এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখব না। উৎপাদন আমাদের বাড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদন নিজেদের করতে হবে। নিজের পায়ে চলতে হবে।’
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বিশ্বপরিস্থিতিটা বিবেচনা করতে হবে। আমরা তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। বিদ্যুৎ শতভাগ দিয়েছিলাম। আজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত করতে হয়েছে। কারণ, আমাদের সার উৎপাদন করতে হবে যে গ্যাস আছে, তা দিয়ে। আমাদের দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে, সেটা তো নয়। আমর অনবরত সিসমিক সার্ভে অব্যাহত রেখেছি। কূপ খনন করছি। গ্যাস যতটুকু পাচ্ছি ব্যবহার করছি। পাইপলাইনে গ্যাস আনছি। আমাদের যেটা করার করে যাচ্ছি। কোথাও আমরা পিছিয়ে নেই।
আজকের বিশ্বপরিস্থিতির জন্য এ ধাক্কায় পড়তে হচ্ছে। তারপরও আলাপ–আলোচনা করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে।’
‘অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কিছু মানুষের কষ্ট হচ্ছে, সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারি’ মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বৈশ্বিক মন্দার যে ঝটকা আমাদের ওপর পড়েছে, তা থেকে কীভাবে দেশের মানুষকে রক্ষা করব, সেটাই আমাদের চিন্তা। ১৫ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। রেশন কার্ড করে দিচ্ছি। এক কোটি পরিবার রেশন কার্ড পাবে। এটা দিয়ে ন্যায্য মূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে পারবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চাই না আমার দেশের মানুষ কষ্ট পাক। আমাদের দায়িত্ব জনগণের প্রতি। যতক্ষণ নিশ্বাস আছে, তা পালন করে যাব। সেটাই হচ্ছে আমাদের প্রতিজ্ঞা। আর এ জন্য সকলের সহযোগিতাও দরকার। শুধু সমালোচনার কথা বললে তো হবে না; সকলকে কাজও করতে হবে, যাতে এই ধাক্কা থেকে আমাদের দেশের মানুষ রেহাই পায়। সবাইকে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস—সবকিছুতে সাশ্রয়ী হতে হবে।’