সংসদ নির্বাচন

জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা অনিশ্চয়তায়

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির (জাপা) আসন ভাগাভাগির বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এমন সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে আসন–ভাগাভাগির প্রশ্নে আলোচনা না করার আভাসও দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।

তবে হঠাৎ করে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কেন এই সন্দেহ প্রকাশ করা হলো, সেটি বোঝার চেষ্টা করছেন জাপার নেতৃত্ব। দলটির কোনো কোনো নেতার মতে, ‘সাবালক’ হয়ে ওঠা জাপাকে আরও চাপে রাখতেই এই সন্দেহ বা অবিশ্বাসের প্রকাশ।

গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপার নেতৃত্বকে নিয়ে সন্দেহের কথা প্রকাশ করেন। বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রিসভার দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না। জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে কী করবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, রওশন এরশাদ, তাঁর ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদকে (সাদ এরশাদ) নির্বাচন থেকে সরিয়ে রেখেছে। তারা (জাপা) কখন কী করবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন সন্দেহ প্রকাশের ঘটনায় এর বিশ্লেষণ ও নানা আলোচনা চলছে জাতীয় পার্টিতে। আলোচনা রয়েছে আওয়ামী লীগেও। এমন পটভূমিতে নির্বাচন, সন্দেহ, আসন–সমঝোতা—এসব প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি, দুই দলের পক্ষ থেকে বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে।

আমরা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আজও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে।
ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

জাপা ভোটে থাকবে বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বনানীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আসছি নির্বাচন করার জন্য, চলে যাওয়ার জন্য না। কেউ যদি বিশ্বাস না করেন, সেটা ওনাদের বিষয়। আমরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নে নাই।’

গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে দুবার কথা বলেছেন। দুই দফায় সাংবাদিকদের কাছে জাপাকে ঘিরে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।

গতকাল দুপুরে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আজও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে।’

এরই মধ্যে দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের বৈঠক হয়।

এরপর বিকেলে তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক কর্মসূচিতে জাতীয় পার্টির ভোটে না থাকার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের দলের অনেকেরই আশঙ্কা আছে; দেশের জনগণের মাঝেও এটা নিয়ে একটা শঙ্কা আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বয়কট করা, ওয়াকআউট করা সব জায়গাতেই আছে। কী হবে, এটা তো এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, হলেও হতে পারে।’

এই সন্দেহ এবং প্রকাশ্যে নানা বক্তব্যের পরও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপা নেতারা যোগাযোগ রাখছেন। গতকাল রাতে ওবায়দুল কাদের ও জাপার মহাসচিব মুজিবুল হকের (চুন্নু) নেতৃত্বে দুই দলের নেতাদের একটি বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সন্দেহ-অবিশ্বাসের পটভূমিতে জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতার বিষয়টি অনেকটাই ঝুলে গেল। তাঁরা এ–ও মনে করছেন, আসন–ভাগাভাগি না হলে জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে।

বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব তথ্যের ভিত্তিতে জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে এমন সন্দেহ করেছেন, এর তথ্য–প্রমাণ তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ বিষয়ে জাপার অবস্থান কী তা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে জাপা নেতারা বলেন, ভোট বর্জনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়েও আলোচনা হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার পুনরায় দুই দলের মধ্যে বৈঠক হবে।

তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সন্দেহ-অবিশ্বাসের পটভূমিতে জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতার বিষয়টি অনেকটাই ঝুলে গেল। তাঁরা এ–ও মনে করছেন, আসন–ভাগাভাগি না হলে জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে। এটা নিয়েও আওয়ামী লীগ খুব একটা চিন্তিত নয়।

জাপার নেতারাও তাঁদের দলকে নিয়ে হঠাৎ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সন্দেহ প্রকাশের বিষয়কে একাধিক দিক থেকে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, এর একটি হতে পারে, সত্যি সত্যি হয়তো জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা করছে। এমন কিছুর আঁচ পেয়ে আগেই চাপ তৈরির কৌশল থেকে বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে দলটি সেদিকে পা না বাড়ায়। আরেকটি দিক হতে পারে, এই অবিশ্বাসের কথা প্রকাশ করে জাপাকে আসন–সমঝোতার ক্ষেত্রে কোণঠাসা করা। এ ছাড়া দলে নতুন করে বিভক্তি বা কোন্দল সৃষ্টি করার কৌশলও থাকতে পারে।

হঠাৎ রওশনের আবির্ভাব

রওশন এরশাদ নিজে এবং তাঁর ছেলে শাদ এরশাদ মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়ায় নির্বাচন থেকে ছিটকে গেছেন। তাঁর অনুসারী নেতারাও জাপার মনোনয়ন পাননি। এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই রওশনের রাজনৈতিক জীবনের শেষ দেখছিলেন। এরই মধ্যে অনুসারীদের নিয়ে তিনি গণভবনে যান।

রওশনের সঙ্গে থাকা জাপা নেতাদের সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন–ভাগাভাগির আলোচনা নিয়ে আপত্তি জানান রওশন এরশাদ। তিনি এ–ও বলেন, জি এম কাদের ও মুজিবুল হকের অসহযোগিতায় তিনি এবং তাঁর ছেলে ভোট করতে পারছেন না।

এ সময় জাপার সঙ্গে আসন–ভাগাভাগির বিষয়ে জি এম কাদের বা মুজিবুল হকের সঙ্গে আলোচনা না চালানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেন বলে রওশনের পক্ষের জাপা নেতারা জানান। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহসহ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। বিকেলের পর থেকে কাজী জাফর উল্যাহকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

গণভবন থেকে বেরিয়ে রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন। পাশাপাশি তাঁর একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের দেন তাঁর অনুসারী নেতারা। এতে বলা হয়, ‘খণ্ডিত জাতীয় পার্টি’ এবং জি এম কাদেরের সঙ্গে কোনো নির্বাচনী জোট না করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন রওশন এরশাদ। এ ছাড়া নির্বাচন অধিক গ্রহণযোগ্য করতে জাপাকে এককভাবে ভোট করার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তিনি।

আওয়ামী লীগ-জাপা যত আলোচনা

৬ ডিসেম্বর গুলশানে জাপার নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছে। এরপর ৯ ডিসেম্বর আবার গুলশানে বৈঠক হয় দুই দলের নেতাদের। এর বাইরে ৫ ডিসেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে জাপা নেতাদের সাক্ষাৎ হয়েছে বলেও আলোচনা আছে।

গুলশানে জাপার সঙ্গে দুটি বৈঠকে অংশ নেওয়া সূত্র বলছে, দুই দিনের আলোচনায় জাপা প্রথমে ৬০ আসন দাবি করে। পরে ৪০ আসনের বিষয়ে নমনীয়তা দেখায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিশ্চিত কিছু বলা হয়নি। তবে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে ২০১৮ সালের কাছাকাছি আসনে ছাড় দেওয়া হবে।

এ ছাড়া বৈঠকগুলোতে জাপা দাবি করে, ছাড় দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও সরিয়ে দিতে হবে। তবে এতে সায় দেয়নি আওয়ামী লীগ। আলোচনা এর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে সমঝোতা হয় ৩৭টি আসনে। তবে ৭টি আসন উন্মুক্ত রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত জাপা জয়ী হয় ২২টি আসনে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও জাপা একধরনের আসন–সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে।

জাপার অন্যতম কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সমঝোতার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছেন।

‘বিশ্বাস-অবিশ্বাস’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে জাপার নেতৃত্বের ওপর সরকারি মহলের অবিশ্বাস তৈরি হয় কিছুদিন থেকে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের অনেক দিন থেকে বলে আসছিলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে সে নির্বাচন কখনোই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। শেষ পর্যন্ত জাপা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেও সন্দেহ এখনো কাটেনি।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন ঘিরে জাপার শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার বিষয়ে কিছু গোয়েন্দা তথ্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবিশ্বাস বেড়েছে। এর মধ্যে এক নেতা মুঠোফোনে কাউকে বলেছেন, সরকার তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম করে বিএনপি ভাঙতে পারেনি। এখন জাতীয় পার্টির কাছে আসা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই। সরকার যদি আসন নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে প্রয়োজনে তাঁরা নির্বাচনই করবেন না। আরেক নেতা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে তথ্য পেয়েছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে জাপাকে নিয়ে সরকারের ভেতরে একটা সন্দেহ তৈরি হয়। এসব তথ্যে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর নজর রাখছে সরকার। আবার জাপার শীর্ষ নেতৃত্বসহ দলটির উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন নেতা সরকারের পাশাপাশি বন্ধুপ্রতিম কোনো কোনো দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এর মধ্যে এক নেতা ১০ ডিসেম্বর দুপুরে সস্ত্রীক এক কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আগের দিন ওই কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আরও দুই নেতা। এর একজন দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয়, অন্যজন পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগে গত সোমবার রওশন এরশাদের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেন বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, জাপায় রওশন এরশাদকেই বিশ্বস্ত মনে করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু জি এম কাদেরের দলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই বাস্তবতাও স্বীকার করেন। তাই সন্দেহের পরও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। তবে জাপা নির্বাচন বর্জন করলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশলকে বিকল্প হিসেবে দেখছেন ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ।