নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে ২০১৪ সালে তানভির আহমেদ তানজীল নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের এক ভাই তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ। এর পাঁচ বছরের মাথায় তোফায়েল আহমেদ এনআইডিতে নিজের ঠিকানা পরিবর্তন করেন। এই ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনআইডিতে ঠিকানা পরিবর্তনের মাধ্যমে ভোটার এলাকা স্থানান্তর করা যায়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে ঠিকানায় প্রথমে ভোটার হয়েছিলেন, সেই এলাকায় নির্বাচন কমিশনের থানা কার্যালয়ে লিখিত আবেদন করতে হয়। সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও জমা দিতে হয়।
ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য তোফায়েল যে আবেদন করেছিলেন, সেখানে রেফারেন্স হিসেবে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘জেনারেল আজিজ আহমেদ, সিএএস, এএইচকিউ’। চিফ অব আর্মি স্টাফ–এর সংক্ষিপ্ত রূপ সিএএস। এএইচকিউ হলো আর্মি হেডকোয়ার্টার–এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তানজীল নাম দিয়ে ভোটার হওয়ার সময় তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ তাঁর ঠিকানা দেখিয়েছিলেন রাজধানীর তেজকুনিপাড়ার একটি হোল্ডিং নম্বর। ঠিকানা পরিবর্তন করার জন্য তিনি ২০১৯ সালে একটি লিখিত আবেদন করেন। সেখানে তিনি নতুন ঠিকানায় উল্লেখ করেন ঢাকা সেনানিবাসের একটি বাসা। স্থানান্তরের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এটি তাঁর নিজ বাসস্থান এবং সেনানিবাসের ওই ঠিকানায় তিনি পাঁচ বছর ধরে থাকেন। পরে তাঁর ঠিকানা পরিবর্তন করা হয়। এখন তাঁর এনআইডিতে সেনানিবাসের ঠিকানাই আছে।
ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য তোফায়েল যে আবেদন করেছিলেন, সেখানে রেফারেন্স হিসেবে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘জেনারেল আজিজ আহমেদ, সিএএস, এএইচকিউ’। চিফ অব আর্মি স্টাফ–এর সংক্ষিপ্ত রূপ সিএএস। এএইচকিউ হলো আর্মি হেডকোয়ার্টার–এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, কোনো আবেদনে প্রভাবশালী কারও সুপারিশ থাকলে কাজটি দ্রুত হয়। আর এ ধরনের কেউ সুপারিশ করে থাকলে কর্মকর্তারা সুপারিশকারীর নাম আবেদনের সঙ্গে ‘রেফারেন্স’ হিসেবে লিখে রাখেন। আবেদনপত্রটি সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে সুপারিশকারীর নাম লিখে রাখা হয় মূলত পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা হলে যাতে সহজে বের করা যায়, কার সুপারিশ ছিল। ঠিকানা পরিবর্তনের আবেদনটিও সংরক্ষিত আছে।
নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখার একজন কর্মকর্তা আবেদনটি ‘বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য’ সুপারিশ করেন।
আবেদন নিয়েও প্রশ্ন
ইসি–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ঠিকানা পরিবর্তনের আবেদনটি যথাযথ ছিল কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ, এ আবেদন করতে হয় থানা কার্যালয়ে। কিন্তু লিখিত ওই আবেদনে কোন কার্যালয়ে তিনি আবেদন করেছেন, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। আবেদনে শনাক্তকারী হিসেবে একজনের নাম দেওয়া হলেও তাঁর ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর উল্লেখ করা হয়নি। তবে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখার একজন কর্মকর্তা আবেদনটি ‘বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য’ সুপারিশ করেন।
নিজেদের নামের পাশাপাশি মা-বাবার নাম পাল্টে এনআইডি সংগ্রহ করেন আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ। তোফায়েল নিয়েছেন দুটি এনআইডি। একটি তানভীর আহমেদ তানজীল নামে, আরেকটি তাঁর আসল নামে। হারিছ আহমেদ এনআইডি নেন মোহাম্মদ হাসান নামে। মোহাম্মদ হাসান নামে করা এনআইডিতে হারিছ নিজের ছবি পরিবর্তন করেন ২০১৯ সালে। হারিছের ছবি বদলানোর জন্যও সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। এটি নিয়ে গত মে মাসে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশিত হয়। তখন ছবি পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করার কথা প্রথম আলোর কাছে অস্বীকার করেছিলেন আজিজ আহমেদ।
আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সম্প্রতি এই সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
আইন অনুযায়ী, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআইডি করা, একাধিক এনআইডি করা এবং এনআইডি জালিয়াতিতে সহায়তা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাবেক সেনাপ্রধানের দুই ভাইয়ের এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে ২০২১ সালে ও চলতি বছর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে গত ১০ জুন এই দুই ভাইয়ের এনআইডি জালিয়াতি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভোটার এলাকা স্থানান্তরের বিষয়টিও তদন্ত করছে কমিটি।
সাবেক সেনাপ্রধানের দুই ভাইয়ের এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদনে যদি দোষী প্রমাণিত হয়, তাহলে কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
দেশের একাধিক থানা ও আদালতের নথিপত্র, সাজা মওকুফ চেয়ে (জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদনসহ সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে হারিছ ও জোসেফের বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম। কিন্তু তানজীল নাম দিয়ে তোফায়েল আহমেদ যে পরিচয়পত্র নিয়েছেন, সেখানে বাবার নাম সোলায়মান সরকার এবং মায়ের নাম ফাতেমা বেগম উল্লেখ করা হয়।
১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ। এ মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এই রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পান।
আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সম্প্রতি এই সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য হয়েছেন।