আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনকে খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যেন সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে সতর্ক তারা। তবে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় সরকার। শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে সরকার এখনো ছাড় না দেওয়ার অবস্থানে রয়েছে।
কোটাবিরোধী এই আন্দোলনের মূল শক্তি সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। এমন বাস্তবতায় সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক দিক থেকে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, শিক্ষার্থী আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কোনো বাধা না দিতে ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিও শক্তি প্রয়োগ না করার নির্দেশনা রয়েছে।
যদিও শুরুতে কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের কেউ কেউ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
২০১৮ সালে যখন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তখন প্রথম দিকে সরকার কঠোর মনোভাব দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছিল নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরির কোটা।
এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামলাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোটাব্যবস্থা বাতিলের আগের সেই সিদ্ধান্তের বিষয়কে সামনে আনা হচ্ছে। একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার কোটাব্যবস্থা আগে বাতিল করেছে। এখনো সরকার সেই অবস্থানেই রয়েছে। আন্দোলনকারীদের কাছে এই বক্তব্য তুলে ধরার জন্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এই বক্তব্য আন্দোলনকারীদের কাছে কতটা আস্থা পাবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি হচ্ছে, একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কোটাব্যবস্থা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে আদেশ দিয়েছেন। সেই আদেশ স্থগিত চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চতর আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এখন আপিল বিভাগে ওই আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে এবং সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত। সরকার আগের অবস্থানে আছে বলেই হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে ওই আবেদন করেছে। মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা রাজনৈতিকভাবে এসব বক্তব্যই এখন তুলে ধরবেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
যদিও শুরুতে কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের কেউ কেউ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আক্রমণ করে বক্তব্য না দেওয়ার জন্য দলের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার পর থেকে মন্ত্রী ও নেতারা সে ধরনের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। বরং বিষয়টি যে আদালতের এখতিয়ারে চলে গেছে, সেটিই প্রচার করছেন তাঁরা। আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ এ–ও বলছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনে তাঁদের দলের সমর্থকদেরও অনেকে আছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকেই কোটাপ্রথা চালু রাখার পক্ষে নন। এ বিষয়ও বিবেচনায় নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব।
দলটির নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপিসহ বিরোধীরা যেকোনো আন্দোলনকে সরকারবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। অতীতে তা সফল হয়নি। এবারও যাতে সফল না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষক আন্দোলনে ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়েছে। শিক্ষকেরা মনে করেন, পেনশনের প্রত্যয় কর্মসূচিতে তাঁদের সুবিধা অনেক কমানো হয়েছে। তবে শিক্ষকদের এ আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না সরকার। কারণ, বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর নেতৃত্বে সরকার–সমর্থক শিক্ষকেরাই রয়েছেন। তাঁদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না, এমন ধারণা আছে সরকারের ভেতরে। ফলে সরকার এ নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়।
একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, তাঁদের শীর্ষ নেতৃত্ব সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি থেকে সরে আসবেন না বলে তাঁরা মনে করেন। সে কারণে সরকার এখনো শিক্ষকদের দাবিতে ছাড় দেওয়ার অবস্থানে নেই। তবে তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষক আন্দোলনের ব্যাপারে সমাধান চাইছেন। সে জন্য শিক্ষকনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যদিও এর আগে বৈঠক করার কথা বলা হলেও তা হয়নি। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, আলোচনার ব্যাপারে সময় নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আলোচনা তাঁরা করবেন।
এটা তো (কোটা) আদালতের রায়ের ব্যাপার। আমরা তো এই কোটা রাখিনি। আদালতে মামলা হয়েছে। তাতে সরকারের কী দোষ? সরকার তো মামলা করেনি।ওবায়দুল কাদের
ইতিমধ্যে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পেনশন কর্মসূচি নিয়ে শিক্ষক আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি আছে। দলটির নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপিসহ বিরোধীরা যেকোনো আন্দোলনকে সরকারবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। অতীতে তা সফল হয়নি। এবারও যাতে সফল না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই মানুষ কষ্টে আছে। বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে না পারলেও দ্রব্যমূল্যের ইস্যুটি নিয়ে সোচ্চার হতে চাইছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে সরকারকে তা কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে পারে। তাই বিষয়গুলোর সমাধানের ব্যাপারেও সরকার তৎপর।
কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধছে। এখনই গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা না হলে এ পরিস্থিতি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে।সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান
গতকাল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং এতে বিএনপির নৈতিক সমর্থনের বিষয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলনের ইস্যু খুঁজছে বিএনপি। আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির কাজই হচ্ছে অন্যদের ইস্যুর ওপর ভর করা। এখন শিক্ষকদের আন্দোলনের ওপর ভর করবে। আবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা তো (কোটা) আদালতের রায়ের ব্যাপার। আমরা তো এই কোটা রাখিনি। আদালতে মামলা হয়েছে। তাতে সরকারের কী দোষ? সরকার তো মামলা করেনি।’
এমন পটভূমিতে রাজনৈতিক দিক থেকেও কেউ যাতে পরিস্থিতির কোনো সুযোগ নিতে না পারে, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকার কথা বলছেন ক্ষমতাসীনেরা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলন ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে হলেও দ্রুত সমাধান করা না হলে সংকট তৈরি হতে পারে। সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান প্রথম আলোকে বলেন, কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধছে। এখনই গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা না হলে এ পরিস্থিতি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে।