বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা

অসুস্থ, প্রবীণ, প্রবাসীরাও আসামি

মামলা হয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে ২৯টির বাদী পুলিশ। ১৭টি মামলা করেন সরকারি দলের নেতারা।

নারায়ণগঞ্জে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে মারমুখী পুলিশ
ছবি: প্রথম আলো

দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় গত ২২ দিনে ৪৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ২১ হাজার ৭০৯। এর মধ্যে এজাহারে ২ হাজার ৭৭৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, বাকিরা অজ্ঞাতনামা। আসামিদের বেশির ভাগই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। এর মধ্যে অসুস্থ, প্রবীণ ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিও রয়েছেন।

১৮টি জেলায় দায়ের হওয়া এসব মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং এসব জেলা থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ২২ আগস্ট থেকে গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির ৪৮টি কর্মসূচিতে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২৫টি স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। আর একই স্থানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশ থাকায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে ১৭টি স্থানে। এসব ঘটনায় যে ৪৬টি মামলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ২৯টির বাদী পুলিশ। বাকি ১৭টি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

সব জায়গায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে না বা সব পুলিশ এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে না। কয়েকটা জায়গায় অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

বিএনপির অভিযোগ, তাদের আন্দোলন কর্মসূচিতে রাশ টানতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একের পর এক হামলার পাশাপাশি পুলিশও বাধা দিয়েছে। এরপর এসব ঘটনায় উল্টো বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং গত ৩১ জুলাই ভোলায় পুলিশের গুলিতে বিএনপির দুই নেতার মৃত্যুর প্রতিবাদে ২২ আগস্ট থেকে সারা দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ধারাবাহিক বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করা হয়।

খুলনায় আগস্টে বিএনপি ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ইট–পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে

৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৩১ জুলাই ভোলার ঘটনা থেকে শুরু করে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় দলের ৩ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। এসব ঘটনায় ২০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। চার হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার জনকে।

এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে।নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর বাজারে গত ৩১ আগস্ট বিএনপি ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি এবং যুবলীগের এক নেতা বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন।
মোহাম্মদ আবদুল আহাদ খান, কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)

ঘটনাস্থলে না থেকেও আসামি

৪৬ মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আসামি হিসেবে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই বিএনপির নেতা-কর্মী। তবে অসুস্থ, বয়সের কারণে চলাফেরা করতে পারেন না, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে আছেন, ব্যবসায়িক কাজে অন্যত্র ছিলেন—এমন ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে।

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় গত ২৩ আগস্ট বিএনপির সভায় হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতারা দুটি মামলা করেছেন। তাতে মোট আসামি ৯৫ জন। এর মধ্যে খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী (৭৫), বাউসাম গ্রামের অসুস্থ শামছুল হক (৭৫), সুন্দরীঘাট এলাকার শারীরিক প্রতিবন্ধী মমরুজ খাঁর (৪৫) নামও রয়েছে।

আক্কাস আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। ঘটনার দিন তিনি এলাকাতেও ছিলেন না। তারপরও তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

আরেক আসামি শামছুল হক একসময় ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করেন তাঁর ভাতিজা খারনৈ ইউপির চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চাচা চোখে কম দেখেন, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগসহ বিভিন্ন রোগের কারণে তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁকে দুটি মামলার আসামি করা হয়েছে।’

ইউপি চেয়ারম্যান ওবায়দুল আরও বলেন, সুন্দরীঘাট এলাকায় মমরুজ খাঁ নামের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে অহেতুক আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বামনগাঁও এলাকায় সাইদুল ইসলাম নামের একজনকে আসামি করা হয়। কিন্তু এলাকায় ওই নামের কোনো ব্যক্তিই নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল আহাদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর বাজারে গত ৩১ আগস্ট বিএনপি ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি এবং যুবলীগের এক নেতা বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন।

মামলার ৪৪ নম্বর আসামি নুর নবী, পেশায় ঠিকাদার। তিনি দাবি করেন, তিনি কখনোই বিএনপির রাজনীতি করেননি। একলাশপুরের আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। মামলার ২১ নম্বর আসামি মহিব উল্যাহর দাবি, তিনি ঢাকায় থাকেন, ঘটনার দিন এলাকায় ছিলেন না।

৪৩ নম্বর আসামি শামসু উদ্দিন ওরফে হেলাল জানান, তিনি ঢাকায় ব্যবসা করেন। ঘটনার দিন অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ছিলেন। তিনি কোনো দল করেন না বলেও দাবি করেন। ১১ নম্বর আসামি আবুল কাশেম (৫৫) অসুস্থ। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বিদেশে আছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে, জানতে চাইলে বাদী যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে শুরুতে দাবি করেন, তিনি সব আসামিকে চেনেন।

এরপর নাম ধরে কয়েকজনের বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে নামগুলো দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন। খানিক পরে তিনি বলেন, বিএনপিকে যাঁরা অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন, তাঁদের আসামি করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় ৪ সেপ্টেম্বর পুলিশের করা মামলায় আসামির তালিকায় আতিকুর রহমান (৪৫) ও মো. রাসেল (৩৫) নামের দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে, যাঁরা বিদেশে চাকরি করেন। আতিকুর ২০২১ সালের ২ আগস্ট ছুটি শেষে সৌদি আরবে ফিরে যান এবং রাসেল দুই মাস ধরে দুবাইয়ে আছেন। তবে আতিকুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য এবং রাসেল একসময় উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

গত ২৯ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজীতে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পরদিন পুলিশ দুটি মামলা করে। দুই মামলাতেই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুকে প্রধান আসামি করা হয়। তিন শতাধিক আসামির মধ্যে চারজন দাবি করেছেন, তাঁরা চাকরি ও ব্যবসার কাজে ঘটনার দিন অন্যত্র ছিলেন। তারপরও তাঁদের আসামি করা হয়েছে।

দুই মামলার একটির বাদী সোনাগাজী মডেল থানার উপপরিদর্শক মাঈন উদ্দিন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে মামলায় আসামিদের নাম দিয়েছেন।

এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও বরগুনার পাথরঘাটায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন দাবি করেছেন, তাঁরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।

পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নেতা-কর্মীরা

১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বিএনপি-পুলিশের সংঘর্ষকালে গুলিতে যুবদলের কর্মী শাওন প্রধান নিহতের ঘটনায় দুই মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাতসহ আসামি ৫ হাজার ৯৭১ জন। এরপর গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমীর খসরু প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা মামলার আসামি, তাঁরা গ্রেপ্তার এড়াতে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও শিবগঞ্জে বিএনপির ৫৫ নেতা-কর্মীকে এজাহারনামীয় এবং ১৮৫ জনকে অজ্ঞাত করে তিনটি মামলা হয়। বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের বিএনপির সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আসামি না হয়েও অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতা-কর্মীরা এখন এলাকাছাড়া।

নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত ১৪টি মামলায় ৪ হাজার ৭২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গায়েবি মামলায়’ অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা এবং পুলিশের গুলির ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, সব জায়গায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে না বা সব পুলিশই এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে না।

কয়েকটা জায়গায় অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় সংগঠন। আমরা কখনোই পুলিশকে প্রতিপক্ষ মনে করি না। আমরা এটাও মনে করি যে তাদের সংবিধানিক যে দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব তারা পালন করবে।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক প্রতিনিধিরা]