আবারও ভাগ হয়ে গেল জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। গতকাল শনিবার ঢাকায় সম্মেলন করে জাপার নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করেছেন রওশনপন্থীরা। এর মধ্য দিয়ে আরেকটি ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ জাপার নেতা হলেন রওশন এরশাদ। আর জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা বলেছে, তারাই মূল দল।
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে গতকাল জাতীয় পার্টির ‘দশম জাতীয় সম্মেলন’ আয়োজন করেন রওশনপন্থীরা। সকাল থেকে নানা রঙের টি-শার্ট, ক্যাপ, ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে সম্মেলনস্থলে আসতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও নেতা-কর্মীরা যোগ দেন। দুপুরের পর নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। তবে নির্বাচন হলেও সে অর্থে ভোট গ্রহণ করা হয়নি।
সম্মেলনে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন ও তিন বছরের জন্য নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করা হয়। ৮০ বছর বয়সী রওশন এরশাদকে করা হয় চেয়ারম্যান। মহাসচিব করা হয় কাজী মামুনুর রশীদকে। সম্মেলনে রাহগির আল মাহি এরশাদকে (সাদ এরশাদ) দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয়। রওশন এরশাদের অবর্তমানে তিনি দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন বলেও সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়।
দলের অন্যান্য পদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশিদ নির্বাহী চেয়ারম্যান, আবু হোসেনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। রাহগির আল মাহি ও আবু হোসেন ছাড়াও কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে আরও চারজনকে। তাঁরা হলেন সাইদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, গোলাম সরোয়ার ও সুনীল শুভ রায়।
সম্মেলনে রওশন এরশাদ বলেন, ‘আজ যদি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হতো, তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে।’ একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, ‘এরশাদের জাপাতে কোনো বিভেদ নেই। সবাই এক আছেন এবং থাকবেন।’
নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকে বিভক্তি
জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই। এরশাদপত্নী রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। তবে ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ায় শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ হন রওশনপন্থীরা। অন্যদিকে রওশনের ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদকে রংপুরে মনোনয়ন না দেওয়ায় নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয় জাপায়। রওশন এরশাদ ও রাহগির আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ) নির্বাচনে অংশই নেননি।
দ্বন্দ্বের জেরে গত ২৮ জানুয়ারি জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। তিনি কাজী মামুনুর রশীদকে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব দেন। একই সঙ্গে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে তাঁদের এই ঘোষণা আমলে নেয়নি জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা। এদিকে এখন সমর্থক নেতা-কর্মীদের নিয়ে পৃথকভাবে সম্মেলন করে রওশন এরশাদ তাঁর নেতৃত্বে জাপার নতুন কমিটি করলেন।
রওশনপন্থীদের এই সম্মেলনে অন্যান্য দলের মধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। এ ছাড়া জাপার পক্ষ থেকে জানানো হয়, জেপি, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ফ্রন্টসহ কয়েকটি দল সম্মেলনে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত চীনের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
‘আরেকটি ব্র্যাকেটবন্দী জাতীয় পার্টি হতে পারে’
লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন তিনি। এই অংশের মহাসচিব মুজিবুল হক (চুন্নু) গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরেকটি ব্র্যাকেটবন্দী জাতীয় পার্টি হতে পারে। কিন্তু জি এম কাদেরের নেতৃত্বে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রওশন এরশাদ ও তাঁর অনুসারীদের তৎপরতাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা। তারা মনে করছে, বয়স ও শারীরিক নানা সমস্যার কারণে রওশন এরশাদ এখন অনেকটাই জীবনসায়াহ্নে। ফলে তাঁকে সামনে রেখে যাঁরা দলকে ভাগ করলেন, তাঁরা বেশি দূর যেতে পারবেন না।
অবশ্য রওশন এরশাদপন্থীদের এই তৎপরতার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগও রয়েছে জি এম কাদেরের জাপায়। এ লক্ষ্যে ৬ মার্চ বনানীতে দলের প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভা করা হয়। এই অংশের সভায় আগামী ১২ অক্টোবর জাপার কেন্দ্রীয় সম্মেলনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এর আগে রোজায় ইফতার অনুষ্ঠান, এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ এবং সাংগঠনিক সফর শেষে আগস্টের মধ্যে সব জেলায় সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে গতকাল সম্মেলন করেন রওশনপন্থীরা; এর মধ্য দিয়ে আবারও বিভক্ত হলো জাপা।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল থেকে নেতাদের ভাগিয়ে নিয়ে গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরে দলটিতে। এর মধ্যে তিনটি ভাঙন ছিল বড় ধরনের, তাঁরা দল থেকে বেরিয়ে একই নামে আবার দল করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দলটির আরও কিছু নেতা দলছুট হয়েছেন, একাধিকবার ছোট ছোট ভাঙনের মুখে পড়েছিল দলটি। বড় ভাঙনগুলো হয়েছিল মূলত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে। এখন নির্বাচন কমিশনেই নিবন্ধিত আছে চারটি জাতীয় পার্টি।