আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখন সরকারের কঠোর সমালোচনা করছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। তবে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ হঠাৎ করেই ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবস্থান দিয়েছেন।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, সারা বিশ্বে ইভিএমে নির্বাচন চলছে। তিনিও ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করবেন।
জাপার একাধিক সূত্র মনে করে, দলের ঘোষিত অবস্থানের বাইরে গিয়ে রওশন এরশাদ এখন যে তৎপরতা চালাচ্ছেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা সরকারের সহানুভূতি ও আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পদপদবি হারানো এবং বহিষ্কৃত কয়েকজন নেতাকে দলে ফেরানোও তাঁর (রওশন) লক্ষ্য।
রওশনের ধারণ করা ভিডিও বার্তাটি গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে প্রচার করেন তাঁর অনুসারীরা। এর আগে গত ৩০ আগস্ট রওশন নিজেকে জাপার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ঘোষণা করেন, যা দলে ব্যাপক বিতর্ক ও বিভক্তির সৃষ্টি করেছে। এর জের ধরে তাঁকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে উপনেতা জি এম কাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় জাপার সংসদীয় দল। এ সিদ্ধান্ত ১ সেপ্টেম্বর স্পিকারকে জানায় জাপা। তবে মাস পার হয়ে গেলেও সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। এর মধ্যেই ভিডিও বার্তায় রওশন জানান, তিনি এখন ‘অনেকটা সুস্থ’, চলতি অক্টোবর মাসেই দেশে ফিরবেন।
রওশন ব্যাংককের হাসপাতাল থেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে আগামী ২৬ নভেম্বর জাপার যে সম্মেলন আহ্বান করেছেন, সে বিষয়ে কথা বলতে তাঁর রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে জাপার সাবেক নেতা দেলোয়ার হোসেন খান, এস এম এম আলম, জিয়াউল হক মৃধা, এম এ গোফরান, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ইকবাল হোসেন ও কাজী মামুনুর রশীদ উপস্থিত ছিলেন। এসব নেতার কেউই অনেক দিন ধরে জাপার কোনো পদে নেই।
জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোলাম মসীহকে জাপার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব করেছেন রওশন। তবে দলে মসীহর প্রাথমিক সদস্যপদও নেই। বাকিদের মধ্যে সবাই দল থেকে বহিষ্কার বা অব্যাহতি পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ দলীয় পদ থেকে বাদ পড়েছেন বা দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় নন।
ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন অবশ্যই করব। জাতীয় পার্টি কখনো নির্বাচন বর্জন করে নাই। ইভিএম হলেও নির্বাচন করব। সারা বিশ্বে এখন ইভিএমে নির্বাচন চলছে। আমাদের দেশে ইভিএমে (নির্বাচন) হবে, এটা তো নতুন কথা নয়। অবশ্যই ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করব।’
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে রওশন এরশাদ বলেন, ‘আমি জানি, নির্বাচন দেওয়া হবে, ভালো নির্বাচন হবে এবং দেশটা এগিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কাজ করবে—যারা জিতে আসবে। দেশবাসী নিশ্চয়ই ভালো থাকবে।’
যদিও জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে বিরোধিতা করে আসছে। গতকালও ইভিএম নিয়ে ভয়ের কথা জানান জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের। লালমনিরহাটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইভিএম মেশিনের ভোটকে আস্থায় নেওয়া সম্ভব নয়। ইভিএমে ভোট চুরির আশঙ্কা আছে। কারণ, ইভিএম মেশিনের পেছনে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁরা সরকারের নির্দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। সরকার যে ধরনের চাইবে, সে ধরনের ফলাফল তারা প্রকাশ করার চেষ্টা করতে পারে।’
জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গতকাল দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সেখানেও তাঁরা গাইবান্ধার উপনির্বাচনে (ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর মৃত্যুতে ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে) ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে।
রওশন এরশাদের বক্তব্যের বিষয়ে মুজিবুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ইভিএম নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা জাতীয় পার্টির নয়। দলের প্রেসিডিয়ামের (সভাপতিমণ্ডলী) বৈঠকে বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ইভিএমের বিরোধিতা করছেন তাঁরা। কারণ, ইভিএমের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। ইভিএমের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে।
গাইবান্ধার উপনির্বাচন ইভিএমে হবে। ইভিএমের বিরোধিতা করে আবার ইভিএম পদ্ধতির ভোটে অংশ নিচ্ছে জাপা—এ বিষয়ে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদিও আমরা ইভিএমে নির্বাচনের পক্ষে না। তবু আমরা গাইবান্ধার উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। আমাদের (জাতীয় পার্টি) কালচার আছে, আমরা নির্বাচন বর্জন করি না। তবে আমরা সিইসিকে ইভিএমের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছি, বলেছি এ নির্বাচনে এটা আপনি বাদ দিতে পারতেন।’
ভিডিও বার্তায় রওশন বলেছেন, বেশ কয়েকটি কারণে তিনি আগামী ২৬ নভেম্বর কাউন্সিল ডেকেছেন। এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি ‘অনেকটা দুর্বল’ এবং ‘এলোমেলো’ হয়ে পড়েছে। আগামী নির্বাচন যাতে ভালোভাবে করা যায়, সে জন্য দলকে শক্তভাবে দাঁড় করানো এবং বহিষ্কৃত ও নিষ্ক্রিয়দের দলে ফেরানোর কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
রওশনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রচার করা ভিডিও বার্তাটি গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ব্যাংককে ধারণ করা হয়। সেখানে রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ ও কাজী মামুনুর রশীদ নামের এক নেতার উপস্থিতিতে ভিডিও বার্তাটি ধারণ করা হয়।
জাপার নেতারা বলছেন, কার্যত জাপার পদপদবি হারানো এবং বহিষ্কৃত কয়েকজন নেতা দলে ফিরতে রওশনকে সামনে রেখে সম্মেলনের নামে জি এম কাদেরের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। এ লক্ষ্যে দু-একজন নেতা ব্যাংককে গিয়ে টাকাপয়সাও খরচ করেছেন। এর আগে রওশনকে এক সপ্তাহের জন্য দেশে এনে ওয়েস্টিন হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করেন জাপার সভাপতিমণ্ডলী থেকে পদ হারানো এক নেতা।
এক প্রশ্নের জবাবে রওশনের অনুসারী গোলাম মসীহ বলেন, জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির যে কাঠামো, তা তাঁরা মানেন। তাঁরা দলে বিভক্তি চান না। সবাইকে নিয়েই রওশন এরশাদ দলকে শক্তিশালী করতে চান।
রওশনের পক্ষে কয়েকজন নেতা গতকাল বেলা পৌনে সাড়ে ১১টার দিকে যখন পুরানা পল্টনে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন, এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে দেখা করে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হকসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন এবং জেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার দাবি নিয়ে তাঁরা সিইসির সঙ্গে কথা বলেন।
সেখানে রওশনের ডাকা সম্মেলনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুজিবুল হক বলেন, ‘আমি জাতীয় পার্টির মহাসচিব, আমার জানামতে কোনো কাউন্সিল নাই। কে কোন কাউন্সিল করল, এটা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্যও নাই, সম্পর্কও নাই। জাতীয় পার্টির নামে আরও বহু দল আছে। তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।’