এবার ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান বিএনপির

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোট ও দলও আজ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে।

মহাসমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম

ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে এবার রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখে পাঁচ ঘণ্টার ‘অবস্থান’ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। আজ শনিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি হবে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তুমুল হর্ষধ্বনিতে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

গত রাতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, গাবতলী, উত্তরা, নয়াবাজার ইউসুফ মার্কেট, শনির আখড়া ও মুক্তি সরণিতে অবস্থান কর্মসূচি হবে।

গতকাল মহাসমাবেশে কর্মসূচি ঘোষণা করে মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁদের এই কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং সাংবিধানিক অধিকার। তিনি কর্মসূচি পালনে সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, ‘আমরা আশা করব, প্রশাসন এই কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে দিয়ে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে।’

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৬-দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, লেবার পার্টি, গণফোরামসহ ৩৬টি দলও আজ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশ ও এবি পার্টি একই কর্মসূচি পালন করবে।

রোদ–বৃষ্টিতেও মাঠে নেতা-কর্মীরা

মহাসমাবেশের স্থান নয়াপল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, নাকি গোলাপবাগ মাঠ—এ নিয়ে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার প্রশাসনের আপত্তিতে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গতকাল নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই বড় জমায়েত করেছে বিএনপি। বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি শেষে সরকার হটানোর এক দফা ঘোষণার পর ঢাকার এই মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘিরে দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এর রেশ দেখা যায় মহাসমাবেশে। দিনভর এই প্রখর রোদ, আবার দুই দফায় বৃষ্টির মধ্যেও নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টন ছাড়েননি।

অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণার আগে মির্জা ফখরুল নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ‘আজ একটি চমক’ আছে জানিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অডিও বক্তব্য দেবেন বলে ঘোষণা দেন। এ সময় নেতা-কর্মীরা একযোগে তারেক রহমানের নামে স্লোগান দেন। তাঁর বক্তব্যের পর বিকেলে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসে। তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

রাতেই নয়াপল্টন জমজমাট

গতকাল বেলা দুইটায় মহাসমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও সকালেই নয়াপল্টনের রাস্তা ভরে যায়। সকাল আটটা থেকেই নেতা-কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন। ঢাকার আশপাশের জেলাসহ সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দেন। এর আগেও বিএনপি ঢাকায় বড় সমাবেশ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গতকালের মহাসমাবেশের বিস্তৃতি ছিল অনেক বেশি। কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, আরামবাগ, দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টনের কয়েক কিলোমিটার রাস্তায় নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের অনুমতি পাওয়ার পর রাতেই অনেক নেতা-কর্মী সেখানে জড়ো হন। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা নয়াপল্টনে অবস্থান নিয়ে মঞ্চ বানান, খিচুড়ি এনে তাঁদের খাওয়া–দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে নয়াপল্টন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দলে দলে মিছিল নিয়ে সমাবেশ মঞ্চের দিকে যাচ্ছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মী। নেতা-কর্মীরা নানা রঙের টুপি মাথায় সমাবেশে অংশ নেন। তাঁদের অনেকে বাঁশি বাজিয়ে, আবার কেউবা বাদ্য বাজিয়ে অংশ নেন।

উপস্থিত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মহাসমাবেশ থেকে সরকার হটানো আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি আসবে, এমন প্রস্তুতি ছিল নেতা-কর্মীদের। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে আসা আবদুল্লাহ বলেন, ‘এ সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে হবে। সে রকম কর্মসূচি না দিলে রাতেই বাড়ি চলে যাব।’

কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ

এই মহাসমাবেশ বাংলাদেশের পরিবর্তনের মাইলফলকে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সারা বাংলাদেশ থেকে আজ ঢাকার নয়াপল্টনে গণতন্ত্রকামী মানুষ, যুবক ও বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই উপস্থিত হয়েছে। তিনি বলেন, এই সরকার বেআইনি, অসাংবিধানিক, অবৈধ। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। দফা এক, দাবি এক, পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে।

বিএনপির মহাসচিব অভিযোগ করেন, বিচার বিভাগ দলীয় সরকারের অধীনে কাজ করছে। খালেদা জিয়াকে বেআইনিভাবে সাজা দিয়েছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্র—সবকিছুকে দলীয়করণ করেছে। কিন্তু এ দেশের জনগণ আর এটা মেনে নেবে না। আমরা একা নই, আন্তর্জাতিক বিশ্বও দেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।

মির্জা ফখরুল বলেন, এই গণবিরোধী সরকার সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে না। এ জন্য মানুষ ভোটেও অংশগ্রহণ করে না। জনগণের এখন নির্বাচনব্যবস্থার ওপর কোনো আস্থা নেই।

ফখরুল বলেন, ‘আমরা এই সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছি। এ আন্দোলনে শরিক ৩৬টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে একমত হয়েছি যে এই অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। কারণ, তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারবে না।

প্রশাসনের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে বেআইনিভাবে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। সংবিধান অনুযায়ী, আইনের শাসন মেনে কাজ করেন। গ্রেপ্তার, হয়রানি বন্ধ করুন, কারাগারে যাঁদের আটক রেখেছেন, তাঁদের মুক্তি দিন।

আজ মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র আশুরা। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ছুটি। তা ছাড়া আজ শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কালকে (আজ) যেহেতু ছুটির দিন আছে এবং পবিত্র আশুরা যেহেতু রাতেই শেষ হয়ে যাবে, সেই কারণে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করব।’

এক দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, এই সরকারের অত্যাচার, অনাচার, গুম, খুনে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জনগণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করেন। রেহাই পেতে পারেন একমাত্র জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আপনারা বলেন, শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না। কথা কি সত্যি?’ সবাই ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিলে তিনি বলেন, রাজপথে থাকবেন? এ সময় সবাই ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিলে এবার তিনি বলেন, ‘যেভাবে কথা দিলেন, সেভাবে থাকবেন। তাহলেই হবে শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’

নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের সমালোচনা করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এখানে ইন্টারনেট নেই। বিএনপির প্রতিটি সভায় ইন্টারনেট থাকে না। এর পেছনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা হচ্ছেন ভোট চোরদের দালাল। মহাসমাবেশ ডাকার পর থেকে কয়েক দিনে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা এ কাজটি করছে, তারাও ভোট চুরির প্রকল্পের অংশ হিসেবে করছে।

১৪ মার্কিন কংগ্রেসম্যানের একটি চিঠির উল্লেখ করে আমীর খসরু সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আর কিছু বাকি আছে? দেশেও নাই, বিদেশেও নাই। কার ওপর ভরসা করে এই ভোট চুরির প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছেন। কেউ নাই, আগেও নাই, পিছনেও নাই। ডানেও নাই, বামেও নাই। পদত্যাগ করে সসম্মানে গণভবন ত্যাগ করুন।’

মহাসমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় অর্ধশত নেতা বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হারুন উর রশিদ, হাবিব উন নবী খানসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকেরা বক্তব্য দেন। এ ছাড়া যুবদল, জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ছাত্রদল, কৃষক দল, শ্রমিক দলের নেতারা বক্তব্য দেন। সবার বক্তব্যেই ছিল সরকার হটানোর এক দফার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির স্পষ্ট বার্তা। সবাই বলেন, এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাজপথে থাকবেন।