আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনের নামে প্রহসন করায় দেশের মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচনের প্রতি তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে।’
আজ বুধবার সকালে রাজধানীর মগবাজারে আল ফালাহ মিলনায়তনে দলের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বার্ষিক অধিবেশনে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এ কথা বলেন। তিনি অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে জামায়াত যৌক্তিক সময় দেওয়ার পক্ষে। তিনি আরও বলেন, ‘বিলম্বিত বা দীর্ঘায়িত সময় নয়, যৌক্তিক সময় দিতে চাই।’
জামায়াত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কথা বললেও বিএনপি গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, তারা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন দেখছে না। দলটির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন সংস্কারবিষয়ক কমিটির প্রধান আবদুল মঈন খান বলেছেন, তাঁরা সত্যিকার অর্থে একটি সঠিক ভোটার তালিকা চান। কিন্তু এর জন্য বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাড়ি বাড়ি যাওয়া অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, অপ্রয়োজনীয় এবং তাতে ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোটার তালিকা আপগ্রেডের (হালনাগাদ) কাজটি করা হলে তা নির্ভুল হবে।
আজ জামায়াতের আমির বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম মৌলিক দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি হলো, রাষ্ট্রের সব প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিককে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিগত সরকার বহু জায়গায় তৎকালীন বিরোধী দলে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের এলাকাগুলোকে টার্গেট করে আসনসংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। তা বিবেক ও বাস্তবতার আলোকে আবার পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন জামায়াতের আমির। তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমতল মাঠ তৈরি করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমতল মাঠ তৈরি করুন। এর জন্য একটি রোডম্যাপ দিন।’
‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল জামায়াত’
পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, এত ক্ষতি অন্য কোনো দলের হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত সারা দেশে পাঁচ শতের অধিক সহকর্মীকে হারিয়েছি। হাজার হাজার মামলা দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে জেলে নেওয়া হয়েছে। কার্যত আমাদের বাড়িঘরই জেলে পরিণত হয়েছিল। জেলের ভেতরেও জেল, বাইরেও জেল। গোটা দেশটাকেই তারা একটা কারাগারে পরিণত করেছিল।’
বক্তব্যে জামায়াতের আমির ৫ আগস্টের গণ-আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের, ২০০৯ সালে পিলখানায় শহীদ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং ‘বিচারিক হত্যার’ শিকার জামায়াতের সাবেক দুই আমিরসহ ১১ নেতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পরের আঘাতটা দেওয়া হয়েছিল জামায়াতের ওপর—এ মন্তব্য করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘দুজন সাবেক আমিরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ আমাদের ১১ জন্য সহকর্মীকে নির্মমভাবে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ তখনো করেছি এবং এখনো করছি।’
জামায়াতের আমির বলেন, ‘২০১৩ সালে আমরা লক্ষ করেছি, শাহবাগের কেন্দ্রস্থলে আসর বসিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তখন দুটি সরকার প্যারালাল (সমান্তরাল) চলছিল। একটা সরকার ছিল সংসদকেন্দ্রিক, আরেকটা সরকার ছিল শাহবাগকেন্দ্রিক। শাহবাগের সরকার সংসদের সরকারের চাইতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল। তাদের কথায় জাতীয় পতাকা উঠত এবং নামত। জাতি বিস্ময়করভাবে এসব বিশৃঙ্খলা লক্ষ করেছে। এসব ট্রমা নিয়ে এ জাতি কোনো রকমে বেঁচেছিল এবং প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।’
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের উল্লেখ করে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, সাড়ে ১৫ বছরের এই জগদ্দল পাথর আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রী, যুবসমাজের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই সরিয়ে দেওয়াও খুব সুখের ছিল না। কমবেশি দুই হাজার আদমসন্তানকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। তাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ, নতুন বাংলাদেশ।’
এ জাতিকে শহীদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে এবং ঋণ পরিশোধের প্রতি যত্নশীল হতে হবে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির।
দোসররা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে
পতিত স্বৈরাচার ও তাদের দোসররা দেশে-বিদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, দেশ যখন পরিবর্তনের ইতিবাচক ধারায় আছে, তখন দেশকে অশান্ত করার জন্য পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা দেশে-বিদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তারা অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এ সমাজকে অস্থিতিশীল করতে চায়। বাংলাদেশের বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক জনতা তাদের ফাঁদ বুঝতে পেরে তাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে।
দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের পরিচালনায় মজলিশে শুরার বার্ষিক অধিবেশনে নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ও আ ন ম শামসুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও সারা দেশের মজলিশে শুরার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।